- বইয়ের নামঃ চশমাটা পালটে ফেলুন
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
চশমাটা পালটে ফেলুন
শীতের সকাল! হরিগোপালবাবু বাড়ির পিছন দিকের বারান্দায় মৌজ করিয়া বসিয়া রৌদ্র এবং সংবাদপত্র সেবন করিতেছেন। এ দিকটা সকালের দিকে অপেক্ষাকৃত নির্জন থাকে, তাই কাগজ পড়িতে এই দিকটিই পছন্দ করেন হরিগোপাল। পাশের আর একটি চেয়ারে পঠিত কাগজখানি আলগা ভঁজে ছড়ানো।
ছুটির দিনে ইংরাজী বাংলা দুইখানি কাগজই রাখেন হরিগোপাল, অন্যদিন কেবলমাত্র বাংলা। রাখেন, সেটা নেহাই বাড়ির সৌষ্ঠব হিসাবে, নচেৎ সংসারের অন্যান্য সদস্যরা কাগজের ধার বড় ধারে না।
সর্বার্থসাধক টি ভি-র দাপটে এখন রেডিও খবরের কাগজ মূল্য হারাইয়াছে। কাগজটা আসে, দুই পুত্র জয়গোপাল খেলাধুলার পাতায় একবার চোখ বুলাইয়া ছড়াইয়া ফেলিয়া যায়, জয়গোপাল জননী কোনও একসময় (প্রধানত শিশি বোতলওয়ালার জন্য) তাহাদের কুড়াইয়া গোছ করিয়া ঘটনা ও দুর্ঘটনা এবং বাজারদরের কলমটা দেখিয়া লন। হরিগোপালের ভ্রাতৃবধূ চকিতে কখন কোন্ কোন্ চিত্ৰগৃহে কী কী-তে নজর বুলাইয়া যান, সেটা কাহারও নজরে পড়ে না।…ভাইঝি টুলি সপ্তাহে একদিন ছোটদেরপাতা খানা ধরিয়া টান মারে। পড়ে না। সেদিনের কাগজখানা হারাইয়া যায়।
একমাত্র হরিগোপালই নিষ্ঠাশীল সংবাদপত্র প্রেমী। তা তাহার তো অফিসেই কাজ মেটে। শুধু এই ছুটির দিনেই বাড়িতে
নিমগ্ন হইয়াছিলেন, সহসা গৃহের অপরাংশ হইতে যেন একটি সমবেত কণ্ঠের তুমুল হর্ষধ্বনি কানে আসিল।
ব্যাপারটা কী? হরিগোপাল কানটা একটু খাড়া করিলেন। নানা কণ্ঠ হইতে উখিত উল্লসিত প্রশ্ন বাচক শব্দে অনুমান হইতেছে, হঠাৎ কোনও ভি আই পি অতিথির আবির্ভাব ঘটিয়াছে। …কিন্তু কে? এমন কে হইতে পারে যাহার জন্য বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়? হরিগোপাল গৃহিণী ও হরিগোপালের কনিষ্ঠ দ্বিজগোপাল গৃহিণী, একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া উল্লাস ধ্বনি করিতে পারে। উঠিয়া গিয়া দেখিবেন না কি?
ভাবিবার পরমুহূর্তেই টুলি তাহার তিনথাক ঝালর ঝোলানো ঘাগরা উড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়া রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করিল, জ্যেঠু শীগগির চলো, দেখো কে এসেছে।
হরিগোপাল ভোলা কাগজ ভাঁজ করিতে করিতে কহিলেন, কে, রে?
তুমি দেখবেই চলো না।
টুলি হরিগোপালের হাতের মধ্যে হাত গলাইয়া বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে, চলো না শীগগির। বঙ্কিমদা এসেছে।
বঙ্কিমদা!
সারা পৃথিবীর সর্ববিধ সংবাদের সারাংশে ভারাক্রান্ত মগজটায় সহসা এই অভাবিত আবির্ভাব বার্তাটির প্রবেশ ঘটিতে বিলম্ব ঘটিল, হরিগোপাল ভু কোচকাইলেন, বঙ্কিমদা! বঙ্কিমদা
ইস! আহা! জানো না বুঝি? ডাবুপিসির ছেলে না? সেই যে তোমার ঘড়িটা সারাতে গিয়ে আর এলো না। রাস্তায় হারিয়ে গেল।
অ্যাঁ! বঙ্কা! হরিগোপালের পায়ের রক্ত চড়াৎ করিয়া ব্রহ্মরন্ধে চড়িয়া গেল, অধিক রন্ধ্র ঘটাইয়া ভেদ করিল না এই রক্ষা।…বঙ্কার আবির্ভাবে বাড়িতে এমন সমবেত হর্ষধ্বনি!! হরিগোপাল আরও বিস্মিত হইলেন মেয়েটার স্মরণশক্তি দেখিয়া। বড়জোর বছর আট নয় বয়স, অথচ পাঁচবছর পূর্বে ঘটিত ঘটনাটা দিব্য মনে আছে।
রুষ্ট হরিগোপাল হাতটা ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, আমার এখন সময় নেই। দেখছিস না কাগজ পড়ছি।
পড়ছো? না চিবোচ্ছো? হি হি হি, জ্যেঠিমা বঙ্কিমদাকে বলল, হি হি, তোর বড়মামা এখন খবরের কাগজ চিবোচ্ছে।…চলো না জ্যেঠু, দেখবে কী ফর্সা হয়ে গেছে বঙ্কিমদা। আর কী সুন্দর স্যুট পরেছে। টাইটা যে কী ফ্যান্টাসটিক!..জুতোটার তো কথাই নেই। আর যা একখানা গাড়ি চেপে এসেছে না। দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে।…একদম শাদা ধপধপে।..নতুন চকচকে।
হরিগোপালের দেহের রক্তকণিকা সমূহ মুহুর্মুহু মাথা হইতে পায়ে, ও পা হইতে মাথায় তাঁতির মাকুর মত ছুটাছুটি করিতে থাকে। বঙ্কা নামক সেই হাড়জ্বালানে লক্ষ্মীছাড়া রকবাজ মস্তান ছেলেটার সহিত টুলি বর্ণিত জিনিসগুলাকে মিলাইতে যে বেগ পাইতে হইতেছে তাহারই ফলশ্রুতি এই ছুটাছুটি।
আচ্ছা, যাবে না তো? কলা কলা! মজার মজার গল্পপা টপো শুনতে পাবে না। উঃ যা না গপপো করছে বঙ্কিমদা, মা বাপী বড়দা জেঠিমা সব্বাই একেবারে হেসে গড়াগড়ি। হি হি মা তো গড়িয়ে খাট থেকে পড়েই যাচ্ছিল। তুমি না–বোকা! বোকা!
দ্রুত প্রস্থান করে টুলি।
কথা বলিতে সময় লাগে না, টুলির এই একটা গুণ। অতএব তার আসা এবং যাওয়ার মধ্যবর্তী অংশটুকু যৎসামান্য মাত্র।
হরিগোপাল ওদিকের ঘর হইতে হাস্যরোল শুনিতে পান। ..ও ঘর টুলিদের। অর্থাৎ মজলিশ বসিয়াছে দ্বিজুর ঘরে। …হরিগোপাল বিস্ময়ে বিমূঢ় হন। দ্বিজু বঙ্কাকে টলারেট করিতেছে?
দূর সম্পর্কের ভাগিনেয় বঙ্কিমবিহারী বা বঙ্কা একদা যখন নিজ মাতুলালয় বোধে এখানে আসিয়া মামারবাড়ির আবদারটি চালাইয়া চলিত, এবং নিতান্তই চক্ষুলজ্জার খাতিরে হরিগোপালকে তাহা সহিয়া যাইতে হইত (তস্য গৃহিণীকেও) তখন দ্বিজগোপাল তীব্র তিক্ত মন্তব্য করিত উঃ কী করে যে তোমরা ওকে টলারেট করো।
পাকে প্রকারে এও জানাইয়া দিতে ছাড়িত না, যে দ্বিজগোপাল যদি এ সংসারের সর্বময় কর্তা হইত, ওই বঙ্কিমবিহারীকে আর এ দরজা পার হইতে হইত না। নিরুপায় দ্বিজগোপাল অতএব বন্ধুর সহিত কথা বলিত না।