–হয়েছে তার কি–তারানাথ বিদ্রূপ-হাস্যে বলেন তোমার ছেলে গিয়ে দাঁড়ালেই একটা চেয়ার এগিয়ে দেবে?
–যাও—হেসে ফেলেন অনুপমা। হাসিটা—দশ-বিশ বছর আগের টাইপের। হেসে বালিশের ওপর এলিয়ে পড়ে বলেন— তোমার সবতাতেই ঠাট্টা! সরোদিকিন, একটু শুই ভালো করে। …ওই যাঃ, মশারিটা টাঙাবো ভাবলাম যে—রোসোটাঙিয়ে দিই। …
—আর থাক—অনুপমার সদ্য বালিশে ফেলা মাথাটার ওপর হাতের একটু চাপ দিয়ে তারানাথ বলে ওঠেন—হয়েছে, খুব হয়েছে, উঠতে হবে না। আজ হঠাৎ এতো কর্তব্যজ্ঞানের উদয় কেন?
–না না, তোমার শরীরটা আজ ভাল নেই—বলে ব্যস্তভাবে উঠে বসেন অনুপমা। ততক্ষণে অবশ্য তারানাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন। গোঁফের ফাঁকে মুচকে একটু হেসে বলেন—আচ্ছা খুব পতিভক্তি হয়েছে! এই সাতাশ বছরের মধ্যে ক’দিন মশারী টাঙিয়েছ?
অম্বলের রোগী তারানাথের সহজে ঘুম আসে না, সুদীর্ঘ দিনের কর্মক্লান্ত আর অভিনয়শ্রান্ত অনুপমা ঘুমিয়ে পড়েন মুহূর্তেই…হয়তো অভিনয়টা নিখুঁত উৎরেছে বলেই এতো স্বস্তি।
অভিনয়?
তা ছাড়া আর কি, সুন্দর নিখুঁত অভিনয়, এততা নিখুঁত যে অভিনয় বলে বোঝা অসম্ভব। বোঝা অসম্ভব কোনটা সত্য কোনটা কৃত্রিম।
কিন্তু একা অনুপমাই বা কেন? নারী মাত্রেই কি অভিনেত্রী নয়? অভিনয় ক্ষমতাই তো তার জীবনের মূলধনা জন্মগত সেই মূলধনটুকু সম্বল করেই তো তার যতো কিছু কাজকারবার।
সে মূলধন যার যতো বেশী, তার-ই তো সংসারে ততো বেশী প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, সুনাম, সুখ্যাতি
নদীর মতো আপন বেগে প্রবাহিত হতে চাইলে চলবে কেন তার?…একদিক ভরাট করে তুলতে অপরদিকে ভাঙন ধরাবার মতো বোকামী তার নেই। দুই কূল সযত্নে রক্ষা করে চলতে হয় তাকে রক্ষা করতে হয় সংসার, রক্ষা করতে হয় দাঁড়াবার ঠাঁই।
অনাদরকে তার বড়ো ভয়, বড়ো ভয় অবহেলাকে!
নাকি এ-তথ্যের সবটাই ভুল?
কোনোটাই তার অভিনয় নয়, চিরন্তনী নারীপ্রকৃতির মধ্যে পাশাপাশি বাস করছে সম্পূর্ণ আলাদাদু’টি সত্তা, জননী আর প্রিয়া। নিজের ক্ষেত্রে সে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
মমতাময়ী নারী তার এই বিভিন্ন দুটি সত্তা বিশাল পক্ষপুটের আড়ালে সযত্নে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে চিরশিশু অবোধ পুরুষ জাতিকে।
ছলনাটা তার ছলনা নয়, করুণা…এই করুণার আওতা ছাড়িয়ে ছলনা-লেশহীন উন্মুক্ত পৃথিবীতে বেপরোয়া শিশু ভোলানাথের দলকে যদি মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো—ক’দিন লাগতো পৃথিবীটা ধ্বংস হতে?