–উচিত তাই খোকা শ্লেষের সুরে বলে—অন্তত যতদিন ওঁর অন্ন ধ্বংসাচ্ছি।
–তাই বৈকি—আমি তো আজীবন ওঁর অন্ন ধ্বংসাচ্ছি করছি যে তাই! ওই সামনা-সামনি দুটো মনরাখা কথা কয়ে যা তা বুঝিয়ে একটু ঠাণ্ডা রাখা, বুঝলি? গোয়ার্তুমি করে কাজ পণ্ড করে লাভ? তোর ঠাকুদ্দা ছিলেন কী দুর্দান্ত রাগী, কিছুতে যদি একবার ‘না’ বলেছেন তো ‘হ্যাঁ’ করায় কার সাধ্যি! আমিই শুধু ভুলিয়ে-ভালিয়ে—খোশামোদ করে—
খোকা এইবার উঠে বসে, উদ্ধতভাবে বলে—কেন করেছে? অন্যায় করেছে। খোশামোদ করবে কিসের জন্যে? বাবাকেও চিরকাল ভয় করে করে আর খোশামোদ করে করে এই অবস্থা! কিন্তু কেন? তোমার নিজের একটা সত্তা নেই? ভালোমন্দ বিচার-বিবেচনা নেই? যুক্তিতর্ক নেই?
সূক্ষ্ম একটি হাস্যরেখা ফুটে ওঠে অনুপমার বাঁকা ঠোঁটের কোণে যুক্তিতর্ক? অনুপমার ভিতরে যুক্তিতর্ক নেই? এতো অজস্র আছে যে, তার প্রবল স্রোত সমুদ্রস্রোতের মতো ভাসিয়ে দিতে পারে বাপ-ছেলে দু’জনকেই। কিন্তু ভাসিয়ে দিলে চলে কই অনুপমার?…বিচার বিবেচনা? সেটা যে আছে, তার প্রমাণ দিতে গেলেই তো সংসার করা কবে ঘুচে যেতো অনুপমারা।
আর সত্তা?
সে বস্তুটাও তো আমসত্বের মতো জলে গুলে রোদে শুকিয়ে ভাঁড়ারজাত করা হয়েছে। খোশামাদের বিরুদ্ধে তো এতো তড়পানি ছেলের, তাকেই বা এতোক্ষণ কি করলেন তিনি মা। হয়ে?
কিন্তু এ সবের কিছুটি উচ্চারণ করেন না অনুপমা, সূক্ষ্ম হাসির রেখাটা সূক্ষ্মতর হয়ে মিলিয়ে যায়। শুধু ম্লান কণ্ঠে বলেন—কেন নেই, সে আর তুই কি বুঝবি খোকা? লেখাপড়া শিখে পণ্ডিত হলেই কি সব বোঝা যায়? আমার মনে আর দুঃখু দিসনে বাবা, তোর সব বন্ধুরা দিব্যি বেড়াতে যাবে, আর তুই পড়ে থাকবি—এ আমি সইতে পারবো না। …উনি না হয় একটু রাগই করবেন। …নিজে কখনো কোথাও যেতে পাইনি, জগতের কিছু কখনো দেখিনি, চিরদিন বন্দী হয়ে থেকেছি, তোরা মন খুলে সব করলেও শান্তি আমার
খোকা অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মনে হয় যেন মায়ের দুই চোখের তারায় পুঞ্জীভূত হয়ে আছে সেই চিরদিনের ক্ষোভ …বঞ্চিত জীবনের, বন্দী জীবনের, নিরুপায় জীবনের!
অতঃপর কথার মোড় ঘোরো চা হাতে করে এসে শীলাও যোগ দেয়া খোকার টাকা হলে। মাকে কোন কোন দেশে বেড়াতে নিয়ে যাবে তারই আলোচনা চলে …খোকার যেটা পছন্দ অনুপমার হয়তো নয়, তাঁর মতে—কতো দুঃখে বেরোনো, তা মুসৌরি কেন? বরং পুরী, ভুবনেশ্বর!…শীলার আদর্শদাদা, অতএব সে মার পছন্দকে উপহাস করো …খোকা আবার তখনি মত পাল্টায়, কেন পুরী, ভুবনেশ্বরই কি যা তা জায়গা? ভারতের স্থাপত্য শিল্পের পৌরাণিক নমুনা। …মার পছন্দকে বরং তারিফই করতে হয়।
অতএব তাই। তৎক্ষণাৎ শীলার কটকী শাড়ী কেনা হয়, ক্ষেত্তরে’র কাঁসার বাসনা আবার পরবর্তী ট্রিপটা সম্বন্ধে গবেষণা চলে। …
দেড়টা বেলা গড়িয়ে সাড়ে চারটায় ঠেকে।
হঠাৎ যেন দরজার কাছে বোমা ফাটে।
–বলি আজ কি আর চা-টা হবে না?
শিহরিত অনুপমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন—চারটে চল্লিশ!…সর্বনাশ! ঠিক চারটে বেলা হচ্ছে—তারানাথের ‘টী টাইম! সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলেই যে তারানাথের হার্টের ট্রাবল বাড়ে!
আচমকা এই প্রশ্ন-বোমাঘাতে নিজের হার্টের অবস্থা যাই হোক, মুখের চেহারাটা ঠিকই রাখেন অনুপমা। সহজ আফসোসের সুরে বলেন—ওমা! এতো বেলা হয়ে গেছে! দেখো কাণ্ড! শীলা, তুইও তো আচ্ছা মেয়ে?…মেধোরই বা কী আক্কেল? বেহুশ হয়ে ঘুমোচ্ছে হয়তো।
—সত্যি—স্বরমাধুর্যে যতোটা তিক্ততা ঢালা সম্ভব তা ঢেলে তারানাথ মন্তব্য করেন—মাইনে করা চাকর-বাকরের আক্কেলটাই বেশী হওয়া উচিত বটে!
স্বামীর কথার উত্তরে—জিভের আগায় কোন কথাটা আসছিলো না অনুপমার?
‘বিনি মাইনের চাকরাণী’র উচিত-বোধের প্রশ্ন?
কি জানি, আসে না তো, কাজেই বোঝা যায় না। শুধু স্বাভাবিক খেদের সুরই ধ্বনিত হয় তাঁর কণ্ঠে—এই দেখোনা, ছেলেটা আবার শরীর খারাপ’ বলে এসে শুয়েছে, কে জানে জ্বরজ্বারি হবে। কি না! যে দিন-কাল!
পরবর্তী সিন দিনে নয়, রাত্রে।
এ ঘরে নয়, ও ঘরো…ঘরের দরজায় খিল লাগানোর পর টাইকো সোডা ট্যাবলেট দুটো আর জলের গ্লাসটা কর্তার হাতে তুলে দিয়ে পানের ডিবেটি নিয়ে বিছানার ওপর গুছিয়ে বসেন অনুপমা…’পান মজাবার’ বহুবিধ উপকরণপূর্ণ কৌটোটি খুলে একটিপ মুখে ফেলে বলেন— বুকের কষ্টটা বেশী হচ্ছে না তো? তোমার তো আবার সময়ের একটু এদিক-ওদিক হলেই কি? তাকানো নেই কেন? রাগ হয়েছে বুঝি? না, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। ছেলেমানুষের মতো রাগ অভিমানটা ঠিক আছে এখনো। …ছেলেটাও হয়েছেন তেমনি বাপের আর কোনো গুণ।
পান, রাগ গুণটা পেয়েছেন মোলো আনা। তখন তোমায় বললাম—খোকার শরীর খারাপ হয়েছে,…শরীর নয় মোটেই, মেজাজ। …ওই যে, বন্ধুদের সব গোছগাছ হয়ে যাচ্ছে তাই মেজাজ খাপপা। রেগেটেগে হুকুম দিয়ে দিয়েছি আমি যেতো শেষটায় মনজরে থেকে সত্যি রোগ করবে, সুধীর শ্যামল সবাই যাচ্ছে যখন, যাকগে একবার দিল্লী গিয়ে কি চারখানা হাত বেরোয় দেখি!…হ্যাঁ, একটা চাকরি জোগাড় করে আসতে পারে—তবে বলি বুদ্ধি! শ্যামলের মামা না যেন। খুব বড়ো চাকরে ওখানকার! আচ্ছা হ্যাঁ গো তোমাদের সুবোধবাবুও না দিল্লীতে বদলী হয়েছেন আজকাল?