হঠাৎ চল্লিশোত্তীর্ণা অনুপমার মুখে এমন একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে,—যেটা চব্বিশ বছরে মানানসই। …তবে উত্তরটা বয়সের অনুপাতেই দেন ভদ্রমহিলা—আহা মরে যাই! আমার ভয়ে তো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছো তুমি!…ভয় করতে হয়—আজকালকার ছেলেদের খোকাই তো সেদিন বলছিলো—ওর কোন বন্ধুর ভাই নাকি বাপের কাছে বকুনি খেয়ে…কে? কে ওখানে?
তারানাথ অগ্রাহ্যভরে বলেন—কে আবার? মেধো হয় তো!
–কি জানি বাবু—অনুপমা সন্দিগ্ধভাবে বলেন—মনে হলো যেন খোকা উঠে গেলো সিঁড়ি দিয়ে। …।
–খোকা আবার কি? এই তো সাহেব সেজে বেরিয়ে যাওয়া হলো বাবুর! পোর্টফোলিও হাতে ঝোলালে বেরোনো হয় না, যেন মস্ত এক অফিসার!
—হ্যাঁ? ওই এক ফ্যাশান ছেলের। কিন্তু ঘুরে আবার আসেনি তো?
—কেন, ঘুরে আসবে কি জন্যে?
—কি জানি, কিছু ভুলে ফেলে গিয়েছে হয়তো। পরশু অমনিকততদূর গিয়ে ছুটতে ছুটতে এলো—ঘড়ি ভুলে গেছে বলে।
—তা আসবেন বৈকি। কজিতে ঘড়ি না বেঁধে বেরোলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবো কই বলো দিকিন ছুটে গিয়ে সংসারের একটা জিনিস কিনে আন? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে লাট সাহেবের!
বিরক্তি-তিক্ত স্বরে কথাগুলি উচ্চারণ করে ছোট এক টুকরো পাতিলেবু গেলাসের জলে গুলতে থাকেন তারানাথা তিন আনা জোড়া লেবু বড়ো বড়ো দুখানা খাওয়া যায় না।
অনুগামিনী সতী অনুপমা পতি-দেবতার এই ধারালো মন্তব্যটির পিঠোপিঠি বেশ ঘোরালো কিছু বলবার আগে একবার উঠে গিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে নিঃসন্দেহ হয়ে এসে বসেন এবং এখনকার ছেলেরা লেখাপড়া শিখেও যে কতো মুখ আর বাঁদর হয় তারই উদাহরণ দিতে তৎপর হয়ে উঠেন… ভাগ্নে-ভাইপো, ভাসুরপো, বোনপো দেখছেন তো সবাইকে অন্ধ স্নেহের বশে নিজের ছেলের বিষয়ে ছেড়ে কথা কইবেন এমন মুখ মা অনুপমা নন …তিন-তিনটে পাশ করে যে ছেলে নির্বিকার-চিত্তে দু’বছর ধরে শুধু আড্ডা দিয়ে আর সিনেমা দেখে বেড়ায়, তার আবার পদার্থ আছে কিছু? কেন, উঠে পড়ে লেগে চেষ্টা করলে কিছু একটা জুটতো না এতোদিন? তবু তো বাপের একটু আসান হতো!
দামী দামী আর ভালো ভালো আরো অনেক কথাই বলেন অনুপমা। ছুটির দিন খেয়ে তাড়াতাড়ি ওঠবার তাড়া নেই তারানাথেরা।
ধীরে-সুস্থে খেয়ে উঠে পানের ডিবে হাতে বাইরের ঘরে চলে যান, ছুটির দুপুরে দাবার আজ্ঞা বসে পাড়ার হিমাংশুবাবুর সঙ্গে। আসার সময় হয়ে এলো তাঁর।
অনুপমা ঠাকুর-চাকর সকলের খাওয়ার দেখাশোনা করে সবে খেতে বসেছেন, মেয়ে শীলা নেমে এসে ব্যস্তভাবে বলে ঠাকুর, উনুনে আগুন আছে তো? থাকে তো একটু চায়ের জল চড়িয়ে দাও চট করে।
চায়ের জল বেলা দেড়টার সময়!
অনুপমা অবাক হয়ে বলেন—এখন চা খাবি?
শীলা বিরক্তস্বরে বলে—আমি কেন?দাদার ভীষণ মাথা ধরেছে—তাই।
—দাদা? খোকা বাড়ী আছে নাকি?…বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে অনুপমার।
—আছেই তো। বেরিয়ে গিয়ে ঘুরে এসে শুয়ে পড়েছে মাথা ধরেছে বলে। …কই ঠাকুর, দিয়েছো?
শীলার চিত্ত-জগতে একমাত্র সম্মানিত ব্যক্তি দাদা।
গোগ্রাসে ভাত ক’টা গিলে নিয়ে ছুটে ওপরে গিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকে একেবারে বিছানায় বসে পড়েন অনুপমা। শঙ্কিতস্বরে বলেন—কি হয়েছে রে খোকা? বেরিয়ে আবার ফিরে এসে শুয়েছিস?শরীর খারাপ হয়েছে?
বলা বাহুল্য, স্নেহাতুর মাতৃকণ্ঠের এই শঙ্কিত প্রশ্নের উত্তর তিনি পান না।
অবস্থা নির্ণয়ের প্রথম পর্যায় হিসাবে গায়ের উত্তাপ পরীক্ষা করতে যেতেই—তৎক্ষণাৎ হাতখানা সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শোয় খোকা।
অনুপমা এ অপমান গায়ে না মেখে পুনঃ প্রশ্ন করেন—কখন এলি তুই?
খোকা নিরুত্তর।
অতএব নিঃসন্দেহ, তার সম্বন্ধে মা-বাপের মধ্যে যে উচ্চাঙ্গের আলোচনা চলছিলো সে তার কর্ণগোচর হয়েছে। তা হোক, অনুপমা তো হেরে ফিরে যাবেন না, তাই সক্ষোভ বেদনায় বলেন
—আজই হঠাৎ শরীর খারাপ করলি? পশু তোদের বেরোবার কথা না?
—বেরোনো? খোকা যেভাবে ভুরু কুঁচকে তাকায়, তাতে আর যাই হোক খোকাত্ব প্রকাশ পায় না। বেরোনো মানে? যাচ্ছি কোথায়?
অনুপমা যেন অবোধ, অনুপমা যেন আত্মবিস্মৃত, অনুপমার যেন এখনো শৈশবকাল কাটেনি, তাই প্রায় শিশুসুলভ সরলতাতেই বলে—কেন, তুই যে বলেছিলি মঙ্গলবারেই স্টার্ট করবে ওরা?
—ওরা করবে তার আমার কি? ওদের নিজের পয়সা আছে, ওরা যা খুশি করতে পারে! হঠাৎ আচমকা প্রায় শীলার মতো ভঙ্গীতেই খিলখিল করে হেসে ওঠেন অনুপমা। বিশ বছর আগে দুধ খেতে নারাজ ছেলেকে যে সুরে কথা বলে কায়দায় আনতেন, প্রায় তেমনি ছেলে ভোলানো সুরে বলেন—ওঃ, তাই বলো—বাবুর রাগ হয়েছে! কে বকেছে—কে মেরেছে—কে দিয়েছে গাল?’…তখন বুঝি ওঁর বাক্যবাণগুলি কানে গেছে? (ওর কথাই শুধু উল্লেখ করেন। অনুপমা, স্বচ্ছন্দেই করেন নিজের অপরাধবোধের লেশমাত্র ধরা পড়ে না মুখের চেহারায়) তাই ভাবছি কি হলো খোকার! নে নে, মন খারাপ করিস নি, টাকা তো আমি দেবো বলেছি।
—তুমি আর কোন আকাশ থেকে টাকা পেড়ে আনবে শুনি? তারানাথ রায়ের টাকাই তো?…শখ করে বেড়াতে যাবার রুচি আমার আর নেই মা, একটু ঘুমোতে দাও। বেকারের আবার শখ-সাধ!
অনুপমা যেন তুড়ি দিয়ে ওড়ান ছেলের কথা—হ্যাঁ, বড়ো তুই বুড়ো হয়েছিস, রোজগারের বয়েস পার হয়ে গেছে একেবারে! তাই ‘বেকার’ বলে একেবারে দেগে দে নিজেকে! ওঁর কথায় আবার মানুষ রাগ করে? কথার কোনো মাথা আছে?…ওঁর কথা ধর্তব্য করতে হলে তো ভালো খেতে নেই, ভালো পরতে নেই, আত্মীয় বন্ধুর বাড়ী যেতে নেই, সাধ-আদ সব শিকেয় তুলে রেখে খালি টাকা আনা পাইয়ের হিসেব কষতে হয়।