অনুপমার মা অবুঝ হতে পারেন, তাই বলে অনুপমা তো হতে পারে না? সে নুনের পাত্র চিনির কৌটো গুছিয়ে তুলতে তুলতে বিচক্ষণভাবে বলে—এ সময় আমি হঠাৎ বাপের বাড়ী গিয়ে বসে থাকলে ঠাকুরঝি কি মনে করবেন বাবা?বাবাকে আপনি ওই কথাই গুছিয়ে বলে দিন।
–তা হয় না বৌমা–কর্তা মাটিতে বাঁ হাতের ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বলেন—মরদকা বাত হাতীকা দাঁত! একবার যখন ‘হ্যাঁ’ বলেছি, তখন ত্রিভুবন উল্টে গেলেও তার নড়চড় হবে না।
তবে আর কি করতে পারে অনুপমা?
মাত্রাতিরিক্ত উজ্জ্বল মুখের ভাবটা ম্লান করে আনতে একটু বেশী সময় লাগে বলেই তৎপর হয়ে শ্বশুরের খড়ম, খড়কে, গামছা ইত্যাদি এগিয়ে দিয়ে তবে বলে—মুশকিল হলো! মাঝামাঝি হঠাৎ এখন নিয়ে যাবার জন্যে যে কি দরকার পড়লো বাবার বুঝিও না …মার শরীরটা খারাপ–
এ ‘মা’ অবশ্য শাশুড়ী।
তাঁর নিটোল দেহখানিতে কোন রোগ বালাই আছে—এমন অপবাদ শত্রুতেও দিতে পারবে, কিন্তু অনুপমা দেয়। কাগিন্নী উভয়ের মনোরঞ্জনের এক উৎকৃষ্ট দাওয়াই।
পরবর্তী সিন দালানে নয় ঘরে, দিনে নয় রাত্রে।
তারানাথকে ছেড়ে যেতে যে কী ভয়ঙ্কর মন কেমন করছে সেই কথাই ছল ছল চোখে বিশদভাবে বোঝাতে হচ্ছে অনুপমাকে।
দুই কর্তা মিলে কথা পাকাপাকি করে ফেললেন, অনুপমা বেচারী করে কি? ওর তো আর এখন শুধু শুধু যাবার ইচ্ছে ছিলো না? হ্যাঁ, একটা উপলক্ষ্য থাকতো—আলাদা কথা। বড়ো অবুঝ অনুপমার মা! অথচ বেহায়ার মতো বলতে পারে না অনুপমা সে কথা!…কাজেই বিরহবেদনার যত রকম লক্ষণ আছে সেগুলো সব প্রকাশ করতে হয়—তারানাথের অভিমান ভাঙাতে।
* * * *
চতুর্থ দৃশ্যও একটা আছে, সে অনুপমার পিতৃগৃহের পটভূমিকায়। …কিন্তু সে কথা থাকা দু’ যুগ পরেরই কথাই বলি ‘দু’ যুগ’ কেন বরং তার বেশীই।
কালের পরিবর্তন হয়েছে বটে স্থানটা ঠিক আছে। ‘পাত্রটাও’ বলা চলে। সেই দালানে—ঠিক সেই জায়গাটাতেই সেই ভঙ্গীতে বসে আছেন গৃহিণী অনুপমা, পাখা একখানা হাতে। …মুখের গড়নটা কিছু বদলেছে, গায়ের রঙের জেল্লাটা গেছে কমে, তবে চুলে যে পাক ধরেছে সেটা এক নজরে চোখে পড়ে না।
সামনে আহারে বসেছেন–বর্তমান কর্তা তারানাথ।
পঁচিশের ওপর আর পঁচিশ যোগ করলে যে পরিবর্তনটুকু অবশ্যম্ভাবী তার বেশী কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না তারানাথের আকৃতিতে।
আসনটা আর বাসনগুলা বাপের আমলের, তবে আহার-আয়োজনটা নয়। তা’তে এ যুগের। শীর্ণ ছাপ! অনুরোধ-উপরোধের কাজটা ফুরিয়েছে গৃহিণীদের। …সচরাচর এ সময় ওই প্রসঙ্গেরই অবতারণা হয়। সে যুগে ‘জলের দরের সঙ্গে এ যুগের ‘অগ্নিমূল্যের তুলনা করে প্রতিদিনই নতুন করে বিস্ময় প্রকাশ করেন অনুপমা আবার এ উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করতে ছাড়েন না—সংসারে এই নবাবী-চাল চেলে আর কততদিন চালাতে পারবেন তারানাথ!
ছেলেটি তো—একেবারে লাট সাহেবের পুষ্যি-পুত্তুর। মেয়েটি বাদশার বেগম। এতোটুকু ত্রুটি হলেই রসাতল। ছেলে-মেয়েদের কান বাঁচিয়েই অবশ্য বলেন অনুপমা, এখনকার ছেলে মেয়েদের তো বিশ্বাস নেই!
আজ আর বাজারদরের আলোচনা নয়—কর্তা রেগে আছেন। অনুপমা নীরব।
খানিকক্ষণ খাওয়ার পর হঠাৎ মুখ তুলে তারানাথ বলেন—কি নিয়ে এতোক্ষণ বচসা হচ্ছিল বাবুর?
বলা বাহুল্য উদ্দিষ্ট ‘বাবুটি’ তারানাথের বয়স্ক বেকার পুত্র। এহেন অম্লরসাত্মক উষ্ণভাষা আর কার সম্বন্ধে প্রয়োগ করা যেতে পারে—উপযুক্ত বয়সের পুত্র ছাড়া?
একটি বিক্ষোভসূচক শব্দের সঙ্গে অনুপমা উত্তর দেন—আর বলল কেন? সেই দিল্লী যাওয়া! বন্ধুরা যাচ্ছে—অতএব ওঁরও যাওয়াই চাই। দিল্লী দিল্লী করে ক্ষেপে উঠেছে একেবারে
তারানাথ বিরক্ত ভাবে বলেন—এখনো সেই ‘খোট’ ধরে বসে আছে? এককথায় বলে দিচ্ছি যাওয়া হবে না, ব্যস।
বলে তো আমিও দিয়েছিলাম গো—অনুপমা পাখা নামিয়ে হাত উল্টে বলেন—শুনলে তো! সেই তক্কই তো হচ্ছিলো ‘কেন যাবো না’—’গেলে দোষ কি’—’লোকে কি যায় না’—’যারা যাবে তারা সব মরে যাবে না কি—‘ ‘—নিষেধের একটা কারণ থাকা দরকার…’ এই সব পাকা পাকা কথা!
নিষেধের কারণ থাকা দরকার!
শোনো আস্পর্ধার কথা! তারানাথের অনিচ্ছাটাই তো যথেষ্ট কারণ। তা ছাড়াও আবার কারণ দেখাতে হবে ছেলেকে? ক্রুদ্ধ তারানাথ বলেন—আমি ওর তাঁবেদার নই যে কারণ দেখাববা! একপাল চ্যাঙড়া ছোঁড়ার সঙ্গে হৈ চৈ করতে যেতে আমি দেবো না। টাকা জোগাবার বেলায় তো আমি ব্যাটা! তবু যদি এক পয়সা আনবার মুরোদ থাকত! চুল-ছাঁটার পয়সাটি পর্যন্ত তো হাত পেতে নিতে হয়—এই হাবাতে বুড়োর কাছে, তবু কী তেজ! কথাই কওয়া হয় না ভালো করে! আমি যেন একটা কীটস্য কীট!
অনুপমার কণ্ঠেও অনুরূপ সুর—শুধু তুমি কেন, কা-কে নয়? জগৎকেই যেন থোড়াই কেয়ার করে ওরা। …দরকারের সময় হাত পাতার কথা বলছো? তা’ হলেও তো বাঁচতাম, মুখ ফুটে চাইলে—মানের কানা খসে যাবে না?…সেই সেধে সেধে দিতে হবে নিয়ে যেন মাথা কিনবেন।
হুঁঃ! তারানাথ গম্ভীর ভাবে বলেন—বললে এখুনি আবার তোমারই মানের কানা খসে যাবে, তবে ন্যায্য কথা বলবো তোমার আস্কারাতেই এ রকম হয়েছে—।
—আস্কারা আবার কি—অনুপমা অসন্তোষ প্রকাশ করেন—মেজাজটি তো জানো না ছেলের? একটান্যায়-অন্যায় কথা বলবার জো আছে?
—আছে কি না আমি দেখতাম…তারানাথ হুমকি দিয়ে ওঠেন বলতে আমি খুবই পারতাম শুধু পারি না তোমার ভয়ে।