- বইয়ের নামঃ অভিনেত্রী
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অভিনেত্রী
অভিনেত্রী
আশাপূর্ণা দেবী
দালানের মাঝখানে গালচের আসন পেতে গোটা আষ্টেক-দশ বাটি আর অভব্য রকমের বড়ো একখানা থালা সাজিয়ে আহারের আয়োজন করা হয়েছে। জামাইয়ের নয়, বেহাইয়ের।
নতুন বৌমার বাপ এসেছেন বিদেশ থেকে।
বাড়ীর গৃহিণী নাকি নিতান্তই লজ্জাশীলা, তাই অতিথির অভ্যর্থনার ভার স্বয়ং বধূমাতারই। তা’ অযোগ্য অধিকারীর হাতে ভার ন্যস্ত হয় নি। নতুনবৌ ছেলেমানুষ হলে কি হয়, তিনজনের আহাৰ্যবস্তু একজনের জঠর-গুহায় চালান করিয়ে দেবার চেষ্টার জন্যে যে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন সেটা তার আছে।
শ্বশুরবাড়ীতে–বাপ ভাই কুটুম, কাজেই বাপের অতিভোজনের জন্যে পীড়াপীড়ি না করবে কেন অনুপমা?
বাপ হেসে বলেন—খুব যে গিন্নী হয়ে উঠেছিস দেখছি? আমার সঙ্গেও কুটুম্বিতা? এতো কখনো খাই আমি?
খান না সে কি আর অনুপমাই জানে না? কিন্তু উপরোধটাই রীতি যে! তাছাড়া—শাশুড়ী সামনা-সামনি না এলেও আনাচে-কানাচে আছেন কোথাও, পরে বৌয়ের ত্রুটি ধরবেনা তাই অনুপমা সোৎসাহে বলে—আচ্ছা মাছটাছ না খেতে পারো থাক, পায়েস মিষ্টি এগুলো তো খাবে? এ সন্দেশ এঁদের দেশ থেকে আনানো—ফেললে চলবে না বাবা!
–না চলে তো তুই খা বসে বসে-বলে বাপ হেসে উঠে পড়েন। ‘অপচয়’ সম্বন্ধে কোনো বক্তৃতা না দিয়েই ওঠেন।।
সাল তারিখের হিসেবে ঘটনাটা দু’ যুগ আগের অপচয়ের ভয়ে অপ্রচুর আয়োজনটা ছিলো তখনকার দিনে বিশেষ নিন্দনীয় একজনকে খেতে বসিয়ে কেবলমাত্র একজনের উপযুক্ত দেওয়া—সে কেমন? ফেলাছড়া না হলে আবার আদর জানানো কি? আহার্য-বস্তুর ওপর মমত্ববোধটা তো মানসিক দৈন্য।
অতিবড়ো কল্পনাবিলাসীও তখন ‘রেশনের বাজারে’র দুঃস্বপ্ন দেখেনি। অতএব—কাক না বেড়াল সম্বন্ধে কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন না হয়েই অনুপমাও বাবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে যায় এবং পাশাপাশি চলতে চলতে প্রায় অস্ফুট স্বরে বলে—আমাকে নিয়ে যাবার কথা বলবে তো বাবা?
এতোক্ষণ বলতে পারেনি, জানতো খাবার সময়টা অনেকের দৃষ্টি নিবদ্ধ আছে এদিকে।
বাপও মেয়ের সঙ্গে স্বরের মিল রেখে বলেন—বলবো বলেই তো এসেছি। এবারে একলা ফিরে গেলে তোমাদের মাঠাকুরুণটি কি আর আস্ত রাখবেন আমাকে?…ভাবছি কাল সকালের গাড়ীতেই নিয়ে যাবো।
আশায় আশঙ্কায় উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় কণ্টকিত কিশোরী-হৃদয়, এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে রাজী হয় না। ‘কাল সকাল’—সে যেন—সুদূর ভবিষ্যৎ!
কিন্তু বৌ’ বলে কথা! দু’ যুগ আগের বৌ। বাপের বাড়ী যাবার ইচ্ছা প্রকাশটাও অমার্জনীয়। অপরাধ তাই পাকাগিন্নীর মতো ফিসফিস করে বাপকে উপদেশ দেয় অনুপমাবেশ গুছিয়েগাছিয়ে বোলো বাবা, জানোই তো আমার শ্বশুর একটু রাগী মানুষ?
—একটু? বাপ প্রায় স্পষ্ট হেসে ওঠেন—বল যে বিলক্ষণ! চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনলে মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। যাক গে—এবারে যেমন করে হোক বলে কয়ে—
কঞ্চিৎ আশ্বস্ত অনুপমা বাপকে চোখ টিপে ইশারা করে চুপ করতো কোথায় যেন পায়ের শব্দ হলো, বাপের কাছে নিয়ে যাবার আবেদন করছে—এ অপরাধ ধরা পড়লে রক্ষে আছে?
শাশুড়ী লজ্জাশীলা হ’তে পারেন, তা’ বলে—এতোদূর সহ্যশীলা তো হতে পারেন না সত্যি!
ঘণ্টাখানেক পরে সেই দালানেই শতরঞ্চের আসন বিছিয়ে, আর–গোটা চার পাঁচ বাটি ঘিরে থালা সাজিয়ে আহারে বসেছেন বাড়ীর কর্তা। সামনে পাখা হাতে অনুপমা।
ইনি কুটুম্ব না হলেও—অনুরোধ উপরোধের মাত্রাটা ওঠে প্রায় কুটুম্বের পর্যায়ে। সেটাও রীতি। ছেলের বৌ যত্নআত্তি করবে এই তো সাধ মানুষের।
তা সে সাধ মেটাতে জানে অনুপমা।
কর্তা বেশ খানিকক্ষণ খাওয়ার পর এক সময় মুখ তুলে যেন হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গীতে বলেন —হ্যাঁ ভালো কথা…তোমার বাবা যে নিয়ে যেতে চাইছেন তোমাকে!
—বাবার কথা বাদ দিন—বলে পাখাটা জোরে জোরে চালাতে থাকে অনুপমা হৃৎস্পন্দনের দ্রুত ছন্দটা পাছে ধরা পড়ে তাই আরো ব্যস্ততা।
–বাদ দিলে চলছে কই গো? শ্বশুরঠাকুর শ্লেষের ভঙ্গীতে কথা শেষ করেন—তিনি একেবারে নাছোড়বান্দা। মেয়ে নিয়ে না গেলে তোমার মা নাকি তাঁকে বাড়ী ঢুকতে দেবেন না শুনলাম!
—ওই তো হয়েছে জ্বালা—দইয়ের ওপর চিনি দিতে দিতে অনুপমা যেন অগ্রাহ্যভরে বলে— মার যে কি বাতিক! মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হলেই কান্না জুড়ে দেবেন! আচ্ছা এ কী? বাবার কি কম মুস্কিল?…সেবারে অমন পুজোর সময় দিদির আসবার কথা ছিলো—আসা হলো না বুঝি, বাস মার সাতদিন খাওয়া বন্ধ। পুজোর সময় কোথায় নতুন কাপড়চোপড় পরবেন—তা’ নয়। আচ্ছা, সব সময় কি আসা বললেই আসা হয়? সংসারের সুবিধে অসুবিধে দেখতে হবে না?
শ্বশুরের মুখের মেঘ কেটে ঈষৎ কৌতুকের বিদ্যুৎছটা দেখা দেয়—আমি তো তোমার বাবাকে কথা দিলাম–বলে পায়েসের বাটীটি কাছের গোড়ায় টেনে নেনা
অনুপমার মুখেও বিদ্যুৎরেখা, কিন্তু সুকৌশলে তার উপর একখানি নকল মেঘ ঢাকা দিয়ে হাতের পাখা নামিয়ে গালে হাত রেখে বলে—সে কি বাবা? কথা দিলেন কি? মার এই শরীর খারাপ, দু’দিন বাদে ঠাকুরঝি আসবেন! বামুনঠাকুর দেশে যাবো’ বলছে—দুশ্চিন্তায় যেন মুষড়ে পড়ে অনুপমা।
—তা’ বললে কি হবে, কথার পিছনে ড্যাশ টেনে কর্তা জলের গ্লাসে দুখানা পাতিলেবু। নিংড়ে তারিয়ে তারিয়ে জলটি খেতে থাকেন