আমি যখন আবার চোখ মেললাম, দেখলাম, সখিনা শাদা বগটাকেও পানকৌড়ির পাশে শুইয়ে দিয়েছে। পরস্পর বিরোধী প্রতিকূল বর্ণের কারণেই হোক অথবা অন্য কোনো দৃশ্যের মহিমাতেই হোক, আমার চোখ দুটি আমার সামনে বহমান শাদাকালো পালকের আপাত সহনশীলতায় কিছু স্বস্তি এবং মুক্তি পেল বলা যায়। আমি আমার ছোট শালীকে বললাম, আজ আর শিকার হবে না, চলো আমরা ঘরে ফিরি।
ফেরার সময় সখিনা শাদা, আর মদিনা কানোপাখিটাকে বহন করে চলল। ওরা আগে আর আমি পেছনে। আমি বুঝতে পারছি আমার মাথার রগ রেশ ফুলে উঠেছে। আমার চোখ কোনো দৃশ্যকে সহ্য করতে পারছে না। মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। আমি অসহ্য মাথাব্যথায় ছটফট করি। রোগটা আমি আমার মার কাছ থেকে পেয়েছি। আমার মাকেও দেখি মাঝেমাঝে অসহ্য মাথাব্যথায় কাঁদেন। কোনো টেবলেট টুবলেটে তার পেইন কমে না। কখনো দেখেছি, ব্যথায় যন্ত্রণায় কাত্ম হয়ে তিনি একধরনের পুজ পাতা, সম্ভবত ঘৃঙ্কাঞ্চল বেটে তালুতে তার প্রলেপ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আমারও এইমুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ার বাসনা জাগছে। এ গ্রামে নিশ্চয়ই দৃঙ্কাঞ্চন পাওয়া যাবে। ঘরে ফিরেই আদিনাকে তুলে আনতে বলব।
আদিনার কথা মনে পড়তেই আমি গাছটার দিকে তাকালাম, না এখন ও দাঁড়িয়ে নেই। ধনেশের ঠোঁট দুরে থাক, কেউ রূপকথার হীরামনের জন্যেও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে না।
আদিনার সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারটা মোটামুটি সহজভাবেই শেষ হয়েছে। বলা যায়। দাবিদাওয়া কোনো প্রতিবন্ধকতা আনেনি। আমার শ্বশুরের শুধু একটি মাত্র শর্ত ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, বিয়েটা হবে গ্রামের বাড়িতে তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে। বিয়ের আনুষ্ঠানিক ঝামেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা গ্রামেই থাকবেন। আমি আমার বন্ধু বান্ধবসহ এসে আস্ত শেষ করে যথারীতি বৌ নিয়ে কুমিল্লায় ফিরে যাব। তারপর ফিরাযাত্রায় আদিনাকে নিয়ে আদা। এখানে ক’দিন থেকে শেষে শ্বশুর শাশুড়িসহ আবার কুমিল্লায় যাত্রা করবো। আমি আর আদিনা মাত্র গতকাল সন্ধ্যায় সেই ‘ফিরাযাত্রায়’ এসেছি।
মাঝেমাঝে আমার যে এমন অসহ্য মাথাব্যথা হয় আদিনা জানত আমরা বিল থেকে বাড়িতে পা দেবামাত্রই আদিনা, আমার ফোলা লালচোখের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, চোখ এত লাল কেন? আমি বললাম, ভয়ানক মাথা ধরেছে। শোব।
আগে মাথাটা ধুইয়ে দেব?
না, আমি দাঁড়াতে পারছি না। বলে আমি বন্দুকটা আদিনার হাতে দিয়ে সোজা শোবার ঘরে ঢুকে কাদাভরা পা নিয়েই বিছনায় লুটিয়ে পড়লাম। আমি স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো পাখি দুটোকে নিয়ে মদিনা ও সখিনার চিল্লাচিল্লি শুনতে পাচ্ছি। সম্ভবত তারা উঠোনে লোক জড়ো করে ফেলেছে। কারণ, আমি শুনলাম, কে যেন পানকৌড়িটার বিশালত্ব এবং পাখিটার রানে যে প্রচুর মাংস হবে, এ নিয়ে তারিফ করছে। পরক্ষণেই আদিনা এসে আমাকে দুটো মাথাধরার বড়ি খাইয়ে, পাথরের মতো নিরেট হয়ে যাওয়া আমার মাথাটা বালিশে তুলে দিলে আমি বালিশ আঁকড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলাম। আমি আর আদিনাকে ঘৃতকাঞ্চনের প্রলেপ দেওয়ার কথা বলতে পারলাম না। কারণ আমি জানতাম, এ ধরনের ওষুধের কথায় আদিনা হাসবে। আদিনা আমার পায়ের কাদা একটা ভজা তেনা দিয়ে বেশ ভালো করে পরিষ্কার করে দিতে দিতে বলল, গাঁয়ে একজন এল. এম. এফ ডাক্তার আছে, তাকে ডাকতে লোক পাঠাব?
আমি বললাম, না। প্রায় চব্বিশঘণ্টা এ ব্যথা থাকবে, ওষুধে কাজ হবে না।
আমার কথা শেষ হবার আগেই আমার শ্বশুর শাশুড়ি ঘরে এসে ঢুকলেন। শ্বশুর বললেন, ডাক্তার ডাকতে আপত্তি করছো কেন? ডাক্তার এসে একটা ব্যবস্থা করে দিন। তুমি ভোরে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে গেলে, মনে হচ্ছে ঠাণ্ডায় মাথা ধরেছে। শহরের মানুষ খালিপায়ে ভেজা দুব্বা মাড়াতে আছে? তার ওপর তুমি এসেছ কাদাপানি ভেঙে।
তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। শাশুড়ি আমার মাথায় জলপটি দিয়ে ব্যথা সারে কিনা তা দেখার জন্য আদিনাকে পরামর্শ দিলেন। আমি বললাম, এ ধরনের মাথাব্যথা আমার মাঝে মাঝে হয়। ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডাকতে হবে না। একটু ঘুমোতে পারলে ব্যথা সেরে যাবে।
আমি যাতে ঘুমাতে পারি আদিনাকে সে চেষ্টা করতে বলে, শ্বশুর-শাশুড়ি ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তারা চলে গেলে আদিনা দরজায় খিল এঁটে দিল। তারপর একটা রুমাল ভিজিয়ে আমার কপালের ওপর জলপটি চেপে ধরে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আজ হবে। ব্যাপারটা বন্ধ হয়েছে।
আমি আদিনাকে বিছানায় উঠে এসে আমার পাশে শুয়ে মাথা টিপে দিতে বললাম। আদিনা হাসল, তুমি এখুনি চাও?
আদিনা বিছানায় উঠে এলে আমি তাকে বুকের কাছে টেনে আনলাম, আমার ব্যথার কোন উপশম নেই। আদিনা তার বুক দিয়ে আমার মুখমণ্ডল ঢেকে দিলে আমি পানকৌড়ির পালকের মতো গাঢ় কালোরঙের মধ্যে আমার জোড়া ভ্রমরের মতো জ্বালাধরা চোখ দুটিকে ডুবিয়ে দিয়ে স্বস্তি পেতে চাইলাম। আস্তে আস্তে কালো পালকের মতো অন্ধকার ফিকে হতে লাগল। লিকার-ভরা চায়ের কাপে ফোঁটা ফোঁটা দুধ মেশালে যেমন হয়, অনেকটা তেমনি। কিম্বা পাঙাশ মাছের পেটের মতো একধরনের ভোর-ভোর অবস্থা এসে আমার চোখের অন্ধকারকে হালকা করে দিল। কেন জানি মনে হল খালবিলে যেসব পাশপাখালি ওড়ে সেসব পাখির গায়ের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে। আর ঠাণ্ডা আরাম-মেশানো বাতাস আমার গা ছুঁয়ে বইছে।