সূর্য বেশ ওপরে উঠে এসেছে। সেই শিশির ভেজা সকাল-সকাল ভাবটা আর নেই। অনেকক্ষণ রোদে থাকায় আমারও গরম লাগছে। যদিও পৌষমাস ও কপাল আর গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। আমি রুমাল বের করে ঘাম মুছলাম। অকারণ বন্দুকের নলটাও একবার রুমালে মুছে নিলাম। একটু যত্ন পেয়েই নলটা চকচক করে উঠল। আমি কার্তুজ ঠেসে দিয়ে সেফটিপিন আর লাগালাম না। পাখিটা এরমধ্যেই আবার ভেসে উঠেছে।
অই, ভেসেছে।
আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল মদিনা। আমি বললাম, দেখেছ। কথা বলো না পালাবে। কিন্তু কার কথা কে শোনে। আমার ছোটো শালী সখিনার বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম। সে তর্জনী তুলে জোরে বলে উঠল, এই যে পাখিটা দুলাভাই, মাছ খাচ্ছে।
পানকৌড়িটা গলা নাড়িয়ে সম্ভবত ছোট গুগলি-শামুক গিলছিল। সখিনার শব্দে আবার তলিয়ে গেল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম দিলে তো ডুবিয়ে। দুবোনই লজ্জিত হয়ে নখ খুটতে লাগল। শেষে আমি হেসে বললাম, যাক এখন থেকে এখানে চুপ করে বসে থাকবে। একদম কথা বলবে না। আমি আর একটু এগিয়ে গিয়ে গুলি করব। তারা বাধ্যের মতো ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে শাদা বগাটার পাশে হাঁটু নামিয়ে বসল।
আমি উঁচুপাড় থেকে দক্ষিণপাশে নিচে জমির মধ্যে নেমে গেলাম। আমার মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধি এসেছে। অবশ্য আমার মতলবটাকে দুষ্টবুদ্ধি না বলে শিকারির সহজাত চাতুরিই বলা উচিত। আমি ভাবলাম, পাখিটা এখন পানির নিচে আছে। এই অবসরে আমি পাড়ের আড়াল ধরে সোজাসুজি পাখিটা যেখানে ডুবেছে, সেখানে তীরের উঁচু জায়গায় উঠে বন্দুক বাগিয়ে বসে থাকব। আর পাখিটা ভাসামাত্রই গুলি করব।
আমি আমার মতলব মতো পাখিটা যেখানে ডুব-সাঁতার করছিল ঠিক সেখানে ঢালু বেয়ে উঠে এলাম। আর একটা হাঁটু মাটিতে ঠেকিয়ে পেশাদার শিকারিদের কায়দায় অন্য হাঁটুর ওপর বন্দুক রেখে পানকৌড়িটা আবার যেদিক ভেসে উঠতে পারে আন্দাজে সে দিকটায় তাক ঠিক করলাম। নিশানা সোজা করা মাত্রই, আমাকে আর অপেক্ষা করতে হল না, কিছু ঘোলাটে বুদসহ পাখিটা লাফিয়ে ওঠা কালবাউসের মতো পানির ওপর ভেসে উঠল। আমি মুহূর্তমাত্র দেরি না করে ট্রিগার টানলাম। এবার আমার দক্ষতার মধ্যে উত্তেজনা কম থাকায়, বন্দুকের আওয়াজটা তীব্রভাবে আমার কানে বাজল। বন্দুকের ধাক্কাটা মোটা লাঠির আকস্মিক গুতোর মতো আমার কণ্ঠাস্থি ও বাহুসন্ধির ওপর এসে পড়ায় আমি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে, পড়লাম। ব্যারেলের হালকা ধোঁয়া নেমে গেল পানির সীমা পর্যন্ত।
প্রথমে গুলি-খাওয়া ভোঁদড়ের মতো একটা বৃত্তাকার ঢেউ তুলে পাখিটা পানির ওপর চক্র মারল। তারপর গলাটা ঢেউয়ের ওপর লম্বাভাবে সমান করে ডানা দিয়ে পানিতে ক্রমাগত বাড়ি মারতে মারতে ঘুরতে লাগল। আর মনে হল, পাখিটা যেখানে গুলি খেয়ে তড়পাচ্চে সেখানে কেউ একবালতি টাটকা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। খালের মধ্যভাগে বেশখানিকটা পানি রক্তে এমন রঙিন হয়ে গেল যে আমি ভেবে পেলাম না, একটা পানকৌড়ির শরীরে এত রক্ত কিভাবে থাকতে পারে। পাখিটা লালরক্ত, সবুজ জল ও তার গাঢ় কালো পালকের আড়ালে যন্ত্রণাদায়ক এক বর্ণের সমারোহ সৃষ্টি করে আমাকে স্তম্ভিত করে দিল। আমার হঠাৎ বোধ হল, আমার মাথাটা ভয়ানক ব্যথা করছে। আমি বন্দুকটা মাটিকে রেখে, এ দৃশ্য থেকে আমার জ্বালা-ধরা চোখ দুটিকে রেহাই দেবার জন্য দুহাতের পাতায় চোখ ঢেকে বসে রইলাম। আমার আরও হাত থাকলে আমি কানেও আঙুল দিতাম। আমার অতিরিক্ত কোনো হাত বা আঙুল না থাকায় আমি অসহায়ের মতো প্রাণপূর্ণ একটা বিপুল কালোপাখির দীর্ণ মণিরগের রক্ত-মোক্ষণের নিঃশব্দ গর্জন কর্ণপটাহে ধারণ করে আচ্ছন্ন ও আবিষ্ট হয়ে গেলাম।
আমি এভাবে চোখ ঢেকে কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। মদিনা ও সখিনার হুড়াহুড়ি, চিৎকার আর উচ্ছ্বসিত সহাস্যে আমি চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তাকালাম। মদিনা পাখিটা তুলে আনবার জন্য খালের পানিতে সাঁতার কাটছে। আর সখিনা পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকে তাড়া দিচ্ছে, তাড়াতাড়ি যা বুবু, পাখিটা ডুবে যাবে যে!
সখিনার ভয়, এ অবস্থায় পানকৌড়িটা ডুবে গেলে আর পাওয়া যাবে না। আমি বন্দুকটা তুলে সখিনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মদিনা ততক্ষণে পাখিটার একটা ডানা ধরে ফেলেছে। পানকৌড়িটা যদিও তখন নড়ছিল তবুও বোঝা যাচ্ছে এখন পাখার ঝাঁপটানিটা কম। পাখিটা নেতিয়ে পড়েছে। পাখিটাকে প্রায় বুকে চেপে ধরে মদিনা পাড়ে এসে উঠল। মদিনার পরনে ছিল আদিনার শাড়ির রঙের মতো হালকা-গোলাপী রঙেরই একটা ফ্রক যা ভিজে গিয়ে গায়ে চামড়ার সাথে সেঁটে গেছে। সে যখন। কালোপাখিটাকে তার বুকের ওপর থেকে নামাল আমি দেখলাম তার কচি ফলের মতো কালো নরম বুকে রক্তের লাল ছোপ গাঢ় হয়ে লেগেছে। মনে হচ্ছে লাল শাপলার আধফোঁটা দুটি কলি পৌষের শিশিরে ভিজে থিরথির করে কাঁপছে। মদিনাও পানি থেকে উঠে শীতে হি-হি করছিল। আমি বললাম, ফ্রকটা খুলে নিংড়ে নাও, ঠাণ্ডা লাগবে। আদিনা প্রথম একটু লজ্জিত চোখে আমাকে দেখল, পরে আমার দিকে পেছন দিয়ে ফ্রক খুলে নিংড়াতে লাগল।
পাখিটা ডানা ছড়িয়ে আমাদের পায়ের কাছে পড়ে আছে। তার চঞ্চু ও বুকে সিঁদুরের মতো একটু-একটু রক্ত এখনও জমাট বাঁধেনি। যদিও পাখিটা নেতিয়ে ঠাণ্ডা মেরে আছে, ও চোখ দুটি ভোলা থাকায় মনে হচ্ছে, খুনি উড়াল দিয়ে পালাবে। আমি পাখিটাকে একদৃষ্টিতে, পলক না ফেলে দেখছিলাম। আমার মাথাধরাটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, চোখ জ্বালা করছে। একভাবে একদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছি না। আমি বন্দুকটা ধরে আস্তে আস্তে পানকৌড়িটার পাশে বসে পড়লাম। তারপর বন্দুকটা ঘাসের ওপর শুইয়ে দিয়ে আবার হাত দিয়ে চোখ ঢাকলাম। আর সাথে সাথেই সেই দৃশ্যটা, পানকৌড়িকে গুলি করার সেই মুহূর্তটি আমার কল্পনার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকল। আমি দেখলাম, বুজ জলের পটভূমিকায় আপন রক্তে রঞ্জিত ঢেউয়ের ওপর একটা অত্যন্ত প্রাণবন্ত কালোপাখি মৃত্যু যন্ত্রণায় তড়পাচ্ছে।