আমি আর দেরি না করে সোজা খালের পাড়ে উঠে গেলাম। পানকৌড়িটা এখনও চক্ষু দিয়ে শরীর আর ডানা খোঁচাচ্ছে। আমি যেদিক দিয়ে উঠেছি এটা হল পাখিটার পেছনদিক। লেজের পালকগুলো ভিজে ভারি হয়ে থাকায় পাখিটা লেজ ফুলিয়ে পালকগুলোকে সাধ্যমতো ছড়িয়ে দিয়েছে। আর ছড়ানো লেজের জন্য পাখিটা আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। আমি বন্দুক তুলে তাক ঠিক করলাম। আমার ডানচোখের মণিতে বন্দুকের মাছি আর পাখিটার প্রসাধনরত কালো শরীর এক বিন্দুতে এসে মিলতেই আমি শরীরটাকে বিশেষত আমার কোমর আর হাতকে স্থির রাখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোনোদিনই কি আর লক্ষ্যস্থলের দিকে পাথরে অথবা ধাতুদণ্ডের মতো অনড় ও অবিকল থাকতে পারে? পারে না। আমার হাত ধরা একমুখি বন্দুকের ভারি ব্যারেলটাও একটু এদিকওদিক হেলে যাচ্ছিল। পাখিটা কিন্তু পালক পাকসাফ করা বন্ধ করে দুটি ডানা দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে গলা লম্বা করে খালের পানির মধ্যে ছোটমাছের ফুটমারা দেখছে। এখন সে অনেকটা উড়ালের ভঙ্গিতে বসে আছে। আদিনা আমাকে দুবাহু মেলে দিয়ে এভাবেই একবার গলা জড়িয়ে ধরেছিল। শুধু একবার। মাত্র ছ’দিন আগে। বাসর রাত শেষ হয়ে গেলে। আমি যখন খুব ভোরে, আমার মায়ের ফজরের নামাজের আগে পুকুরে যাওয়ার জন্য দুয়ার খুলতে খাট থেকে নামলাম, আদিনাও বিছানা ছেড়ে আমার পেছনে এসে পিঠের দিক থেকে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, এসো আরও কতক্ষণ শুয়ে থাকি। আমি জানি তুমি রাগ করেছ। এই আমার প্রথম রক্ত। তুমি নোংরা হয়ে যেতে, তোমার গা ঘিনঘিন করত।
আমি তার হাত ধরে পেছন ফিরে হাত দুটি উঁচু করে ধরলে যেমন লেগেছিল, পানকৌড়ির ডানা ছড়ানো শরীরটাকে এখন আমার বন্দুকের মাছির ওপর দিয়ে তেমনি লাগছে।
আমি বন্দুকটা নামিয়ে নিলাম। না, কোনো দয়ামায়া, স্মৃতি বা কবিত্বের তাড়নায় নয়। আমি ভুল করে পাখিটার পেছন দিক থেকে লক্ষ্য স্থির করেছি। অথচ পাখি শিকারিরা কোনোদিন পেছনদিক থেকে গুলি করে না। আগে আমি কোনোদিন করেছি বলে মনে পড়ল না। কেন করে না? সম্ভবত শিকারের মুখোমুখি না হলে বারুদবর্ষণকারীরা কোনও আনন্দ পায় না। বীর্যবর্ষণকারীদেরও যেমন রমণলিপ্তা নারীর মুখমণ্ডল, বাহুমুল, স্তনযুগলের প্রত্যক্ষ অবলোকন ও পেষণের প্রয়োজন অবধারিত হয়ে ওঠে, কারণ এসব উপাচারের স্বতঃস্ফূর্তি রক্তকে মথিত করলে পুরুষের শরীর একা নিক্ষেপনীতিতে ঋজু হতে হতে এক অন্তরালবর্তী পুলকময় সত্তাকে নির্গলনে বাধ্য করে। যদিও বেগবান বারি জরায়ুকে বিদ্ধ করবে কি করবে না, এ নিয়ে বর্ষণকারীদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না বারুদবর্ষণকারী শিকারির নীতিও তেমনি। তারাও মুখ, বুক, ডানার বাম ও দক্ষিণ পাশ্ব, গ্রিবার বাঁকটা একটু দেখে নিয়ে তাক ঠিক করে। এছাড়া পানকৌড়িটা সম্বন্ধে একটু বেশি সতর্কতা আমার মানসিকতাকে অভিভূত করে ফেলেছিল। পাখিটা সুন্দর। পাখিটা আমার চাই। আমার ভয় ছিল, পেছনদিকে থেকে গুলি করলে প্ররা পালকে পিছনে যাবে, মাংসে পৌঁছবে না। আমি বন্দুকটা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাখিটা আবার পাখা গুটিয়েছে। এখন চক্ষু দিয়ে ডানার দুপাশে আলতোভাবে ঘষছে।
আমি পেছন ফিরে দেখলাম, মদিনা আর সখিনা আবার হাঁটা শুরু করেছে। হয়তো তারা আমাকে বন্দুক নামিয়ে ফেলতে দেখে তাক ফসকেছে ভেবে দ্রুত ছুটে আসছে। এখন হাতের ইঙ্গিতে থামতে বললে পাখিটা সচকিত হয়ে উড়ে যাবে। আর যদি এভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি তাহলেও দুই সহোদরার অসাবধান উপস্তিতিতে পাখিটাও পালাবে। আমি মুহূর্তচিন্তা করে স্থির করলাম, না গুলিই করব। আমি আরও দুপা এগিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়ালাম। এখান থেকে পাখিটা মাত্র পঁচিশ গজ দূরে শুকনো মুলিবাঁশের ওপর বসে আছে। যদিও আমি এখনও পাখিটার পেছনদিকেই আছি আমি বু দক্ষিণ পার্শ্বের খানিকটা অংশ আবছা মন দেখতে পাচ্ছি।
আবার বন্দুক তুললাম। আর কোনোরকমে ব্যারেল সই করেই ছুঁড়লাম গুলি। মুলিবাঁশের ওপর জ্ঞরার শব্দটা এসে আমার কানে লাগল। পাখিটা আমার চোখের সামনে উড়ে যাচ্ছে। প্রথম গুলির শব্দে হাত দুয়েক শূন্যে লাফিয়ে উঠে বিপদ কেটে গেলে অবলীলায় দুটি ডানা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে খালের দিকে নেমে গেল। তারপর পাখা দুটি মৃদুভাবে কাঁপাতে কাঁপাতে প্রায় জল ছুঁইছুঁই অবস্থায় অনেকটা দূরত্ব পার হয়ে ঢেউয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর একবার পাখার ঝাঁপটে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নিয়ে ইতস্তত দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখে নিল। আমার দিকেও মুখ যোরাল। দ্রুত। অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে দেখে নিয়ে ঢেউয়ের দিকে গলা লম্বা করে কাঁথার। ওপর ছুঁচ গাঁথার মতো শরীরটাকে পানির ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে ডুবে গেল। আমি স্তম্ভিত হয়ে খালের উঁচুপাড়ে বন্দুক হাতে বসে পড়লাম। আমি প্রকৃতিতে, ভেজা কালো পালকলা একা পানকৌড়ির নিজস্ব জগতে, তার সচ্ছলতা, সাহস, উড়াল, গ্রিবাভঙ্গি, দর্প, আত্মরক্ষা, আহারপদ্ধতি, সর্বোপরি স্বাধীনতা ও সৌন্দর্য দেখে হিংসায় বন্দুকের গরম নলে গাল চেপে বসে রইলাম।
কল করতে করতে, হাত ধরাধরি করে মদিনা আর সখিনা খালপাড়ের ঢালু জমিতে বুজ লম্বা ঘাসের গালিচায় তাদের পায়ের কাদা সাফ করছে।আমি আঙুল দিয়ে বিলের হাঁটুসমান পানিতে উবু হয়ে ভেসে থাকা ধবগাটা দেখিয়ে দিলে তারা ছুটল সেদিকে। আমি মেয়ে দুটির আনন্দ আর ছোটাছুটি দেখে মনে মনে হাসলাম। উন্মুখ মাঠ, কোমর বাঁকানো নদী, ছোটো হ্রদের মতো বিল বা জলাশয় কিংবা সর্বগ্রাসী নিঃসীম বুজে ডুবে যাওয়ার সুযোগ এরা জীবনে কমই পেয়েছে। পৃথিবীর ম্যাপের মধ্যে এশিয়ার যোনির মতো দেখতে সুজগুল্মলতায় রো একটি বদ্বীপে, যেখানে জলোবাতাসে নিশ্বাস টানতে টানতে কিশোরীরা নানবছরেই শরীরের সমস্ত গিরো উন্মোচন করে বেড়ে ওঠে, পাটশ্বর্ণ গন্নিী হরিণীর লম্বা চোখের মতো চোখে কালো মোটারেখা টেনে কাজল আঁকে, দুই রেখার মাঝে কাঁচপোকার টিপ পরে, ঝাউয়ের ঝালরের মতো পিঠের ওপর উদ্দাম চুল খুলে দিয়ে বেড়ায়, তাদের পিতামাতার কেন যে স্থায়ী আবাস, পাথরের স্ত্রবাড়ি, কংক্রিটের নগরনির্মাণের প্রতিযোগিতায় সর্বস্ব ব্যয় করে দিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তা ভেবে আমি একাকি হাসলাম।