বন্দুকের আওয়াজ বেশি বড় হল না। কিম্বা হয়তো বেশ জোরেই হয়েছে, আমি ঠিক ধরতে পারিনি। স্ব শিকারিরই গুলি করার মুহূর্তে স্নায়ু উত্তেজিত থাকায় কর্ণকুহরে শব্দের ধাক্কা কোনরূপ ক্রিয়া করে না বলে জানি। আমারও বোধহয় তেমনই ঘটল। আমি বন্দুকটা ভাগ করে কার্তুজের খোলসটা ফেলে পেছনে তাকালাম। হ্যাঁ, বন্দুকের শব্দে আদিনা আমার দুই শালীকে নিয়ে আমগাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। শালীরা হাত নেড়ে কী যেন বলছে। আমিও হাত তুলে সাড়া দিলাম।
আর ঠিক তখনই কালো পাখিটাকে দেখলাম। চানধল বিলের পাশ দিয়ে যে ছোট খালটা মেঘনায় গিয়ে মিশেছে, সেই খালের কিনারায় নাওবাঁধার একটা শুকনো বাঁশের আগায় পাখিটা উড়ে এসে বসল। কালো একটা বড় সাইজের পানকৌড়ি। আমার অবস্থান থেকে বাঁশটা পঁচিশ গজও হবে না। পাখিটা বসার সময় একটা সুন্দর শব্দ করছিল আর ভেজা পাখা নাড়ছিল।
পাখিটার বসায়, পাখা নড়ায়, গায়ের কুচকুচে কালো রঙে একটা জীবিকাবিজয়ী প্রাণীর দর্প ফুটে বেরুচ্ছিল। সতর্কতামিশ্রিত একধরনের দৃষ্টিপাতে, যা কেবলমাত্র বুনো পাখ-পাখালিরাই পারে, পানকৌড়িটা আমাকে একবার দেখে নিয়ে খালের পানির দিকে তাকাল। আমি মুহূর্তে অনেক দূরে দাঁড়ানো আদিনাকে ভুলে গিয়ে পাখিটাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। দেখামাত্রই পাখিটাকে, আমার বেশ ভালো লেগেছে। বলা যায়, পাখিটার স্বতঃস্ফূর্তি ও সৌন্দর্য আমার মন কেড়ে নিল। কোথা যেন আদিনার সাথে পাখিটার একটা মিল আছে। আমি শাদা বগাটার পানিতে ভেসে থাকা শরীরটার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আদিনার সাথে পানকৌড়িটার কোথায় অমন মিল আছে আমি ধরতে পারছিলাম না। অথচ পাখিটা যই পালক ঝাড়ছে, গ্রিবা দুলিয়ে এপাশ ওপাশ দেখছে ততই মনে হচ্ছে আমি আদিনার মধ্যে এরূপ ভাবভঙ্গি দেখেছি। অথচ আদিনার ডানা অথবা চঞ্চ থাকা একটা অসম্ভব ব্যাপার। নেইও। অবশ্য আদিনার গায়ের রঙ ময়লা। ময়লা বললে যেমন একটা মায়ামমতাময় কালোরঙকে বোঝায়, আমার স্ত্রীর একটা মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। সেটা তাজা একটা সতেজ ভাব। আদিনা কালো হলেও যেমন তার চামড়ায় সতেজ ভাবটা সময় লেগে থাকে, পাখিটার কালো তেলতেলে পালকের মধ্যেও তেমনি ভাবটা দেখেই আমি নিতে পেরেছি। মাঝে মাঝে সকালবেলার শিশিরভেজা ঘাসেও এই প্রলঔজ্জ্বল্য আমার মন ভুলিয়ে দিলে আমি আদিনার কথা ভাবি।
আমি যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছি তখন ফ্রকরা একটি শ্যামলা মেয়েকে দেখতাম আমার বিধবা মায়ের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে বারান্দায় কথা বলছে। মেয়েটি পাশের বাসার আকিল সাহেবের মেয়ে। আদিনা। রোব্বার সে প্রায়ই মায়ের কুটনো কুটায় সাহায্য করতে আসত। কখনো দেখতাম আমার মায়ের আধপাকা চুল বিলি করে দিতে দিতে শুকনো আচার চুষছে।
যে বয়সে কিশোরীরা তাদের হঠাৎ গড়ে ওঠা শরীর সম্বন্ধে সচেতন থাকে না, আদিনার ছিল সে বয়স। বড় জোর দশ কি এগার। বার ত্রেও হতে পারে, আমি ঠিক জানিনা। দেখতে যদিও সে হালকা পাতলাই ছিল সু তার বাহু ও বক্ষবিতান সুডৌল হয়ে উঠেছিল। সে কমলারঙের খাটো ফ্রক পরত বলে একদিন আমি তার উতও দেখে ফেলেছিলাম। সে নীলডাউনের মতো হয়ে বারান্দায় মায়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। ঠিক সেসময় মায়ের চালতার আচারে কাউয়া এসে বসলে, মা কাউয়া তাড়াতে উঠলেন। পড়ার ঘর থেকে আমি তখন নীলডাউন অবস্থায় থাকা আদিনার উরুযুগল দেখেছিলাম। কারুকার্যময় খিলানের বিশাল দুটি থামের মতো মনে হয়েছিল হাঁটুর ওপরের অংশকে। আদিনা তার খাটো ফ্রকটাই আবার শাড়ির আঁচল গোঁজার মতো করে দুপাশ থেকে জমিয়ে নাভির ওপর বেঁধে কাজ করত বলে, আমি দেখার সুযোগটা পেয়ে যাই।
আদিনা আমার পড়ার ঘরেও মাঝে মাঝে আসত। অকারণে নয়, সিগ্রেট ধরাবার আগুন চাইলে, মা রান্নাঘর থেকে দেশলাই অথবা শোলার ডগায় আগুন দিয়ে আদিনাকে কখনো-সখনো আমার ঘরে পাঠাতেন। আদিনা আগুন হস্তান্তর করে তার ফ্রকের সামনের দিকটা দিয়ে ঘামে-ভেজা মুখটা মুছতে গেলেই আমি তার নাভিও দেখেছি। তার নাভি দেখলে মনে হত তার জেগে ওঠা তলপেটের পেশিকে ভারসাম্যে আনার জন্যে এধরনের জবা ফুলের মতো গভীর নাভিমণ্ডলের একান্ত প্রয়োজন ছিল।
আদিনার সাথে কালো সিক্তডানা পানকৌড়িটার ভাবভঙ্গির খানিকটা মিল খুঁজে পেয়েই কিনা জানিনা, আমি আর চোখ ফেরাতে পারছি না। অথচ গুলি করতে হলে আমাকে অতি সাবধানে অন্তত খালপাড় অবধি হেঁটে যেতে হবে।
পানকৌড়িটা এখন তার ঠোঁট দিয়ে ভেজাপালক খেলাল করছে। আমি এ অবসরে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে নামলাম। সাবধান থাকা সত্ত্বেও এবার আমার পা বেশ খানিকটা কাদার ভেতরে ডেবে গেল। আমি কাদাভরা পা টেনে খালপাড়ে পৌঁছে একটু দাঁড়ালাম। এখানে দাঁড়িয়ে বন্দুকে নতুন কার্তুজ ভরে নিতে হবে। আগে আমি ঘাসের ওপর পা ঘষে চামড়ার মতো পুরো কালো আঁঠালো কাদাটা সাপ করে নিলাম। কাদা উঠে গেলে পাটা বেশ হালকা বোধ হল। আমি কার্তুজ ভরার আগে শেষবারের মতো আবার আমার শ্বশুরবাড়ির সামনের আমগাছটার দিকে তাকালাম। আদিনা এখনও গাছটার নিচে গোলাপি রঙের কালোপেড়ে শাড়িটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার ছোট দুবোন, আমার শালী মদিনা আর সখিনা মাঠে নেমে আমার দিকে সোজা দৌড়ে আসছে। সম্ভবত বন্দুকের আওয়াজ পেয়ে এরা শিকারটা নিতে আসছে। আমি একবার ভাবলাম মেয়ে দুটি কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। ততক্ষণে পাখিটা যদি উড়ে যায় ভয় থাকায় আমি বন্দুকে কার্তুজ ভরে নিয়ে হাতের ইঙ্গিতে মেয়ে দুটিতে দৌড়াতে মানা করতেই তারা বিলের কাছাকাছি একজায়গায় থেমে গেল। সম্ভবত তারা বুঝতে পেরেছে আমি আরেকটা গুলি করতে যাচ্ছি।