অসম্ভব। আপনাকে কিছুতেই যেতে দেয়া হবে না।
হতাশ হয়ে তিনি বসে পড়েন।
শুরু হয় গল্প। সেই গল্পে আর যাই থাকুক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য থাকে। এরা আমার অতি প্রিয়জন। নিজের অপমান আমি সহ্য করতে পারি, বন্ধুদের অপমান কখনোই না।
প্রকাশকদের কথা বলা হচ্ছে–হ্যাঁ আমাকে দিয়ে তাদের কিছু স্বার্থ সিদ্ধি তো হবেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুললে চলবে না। এঁরা আমার উপর যতটা নির্ভরশীল–আমি তাদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমার লেখা এদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে পৌঁছে দিচ্ছেন তারাই। আজকের এই বইমেলার বিশাল আয়েজনের নেপথ্য নায়ক এঁরাই। পাঁচ বছর আগের বইমেলার সর্বাধিক বিক্রিত একটি গ্রন্থের বিক্রয় সংখ্যা ছিল সাত শ। আজ একজন নবীন লেখকের লেখাও মেলার প্রথম দশদিনে এক হাজার কপির বেশি বিক্রি হয়।
মানুষকে গ্রন্থের প্রতি আগ্রহী করার প্রধান ভূমিকা এই প্রকাশকদের। এঁরা ব্যবসায়ী। একজন ব্যবসায়ী লাভ-লোকসান দেখবেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এরা লাভ-লোকসান বিবেচনা করে চিনি বা পেঁয়াজের ব্যবসায় যাননি। এসেছেন বই-এর ব্যবসায়, যার কোন স্থিরতা নেই। এঁদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে পাশের দেশের শক্তিমান প্রকাশকদের সঙ্গে। যাদের আছে দীর্ঘদিনের প্রকাশনার অভিজ্ঞতা।
আমার বই-এর যারা প্রকাশক তারা সবাই অল্পবয়স্ক। কারো বয়সই আমার। চেয়ে বেশি নয়। প্রতিষ্ঠিত পুরানো প্রকাশকরা আমার প্রতি আগ্রহী হননি। আগ্রহী হয়েছেন তরুণ-প্রকাশকরা–আজ আমাদের প্রকাশনা শিল্পের যে জয়জয়কার তা তাদের উদ্যম এবং কর্মপ্রচেষ্টার সোনালী ফসল।
কলকাতার প্রকাশকরা সেখানে আমার নয়টি বই প্রকাশ করেছেন। মনিলিখো কাগজ নামে চমৎকার কাগজ ব্যবহার করেছেন। তারপরেও সেসব বই এবং এদেশে। প্রকাশিত আমার বইগুলি যখন পাশাপাশি রাখি তখন কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই বলতে বাধ্য হই–আমাদের দেশে প্রকাশিত বইগুলির প্রকাশনা মান অনেক অনেক উপরে।
আমরা যাত্রা শুরু করেছি–এই যাত্রা দীর্ঘ যাত্রা। পথ তৈরি নেই। বন কেটে পথ বানাতে হচ্ছে। বানাচ্ছেন এই সময়ের তরুণ প্রকাশকরা। তাদের মুখ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাইলে করা যেতে পারে। কিন্তু এই মুর্খ(!)রাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন যেন। দেশ থেকে মুর্খ শব্দটি উঠে যায়।
আমার বন্ধু এঁরাই। মহা আঁতেল বিজ্ঞ পণ্ডিতরা নন। আমার লেখা ছেপে ওঁরা যে অপরাধ করেছেন–বিজ্ঞ পণ্ডিতদের লেখা ছেপে সেই অপরাধ তারা কাটান দেবার চেষ্টাও করছেন। অন্তত এই ধন্যবাদটুকু তো তাদের প্রাপ্য।
আমার বাবার জুতা
বিজয় দিবসের কতো সুন্দর স্মৃতি মানুষের আছে। সেসব স্মৃতিকথা অন্যকে শোনাতে ভালো লাগে। প্রেমিকার প্রথম চিঠি পাওয়ার গল্প বলার সময় যেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়, বিজয় দিবসের গল্প বলার সময়ও তাই হয়। আমার বন্ধু দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরীকে দেখেছি বিজয় দিবসের স্মৃতিকথা বলার সময় তার চোখে পানি এসে পড়ে। যদিও তেমন কিছু উল্লেখ করার মতো স্মৃতি নয়। তিনি তার মুক্তিযোদ্ধা দলবল নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনলেন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। যুদ্ধের অবসান হয়েছে, আর গুলি ছুঁড়তে হবে না। তিনি রাইফেল ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে শুরু করলেন। এই গল্প বলার সময় কেউ কাঁদতে শুরু করলে তাকে দোষ। দেওয়া যায় না।
আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা বিজয় দিবসের স্মৃতি এভাবে বলেন, খবরটা শোনার পর কানের মধ্যে তবদা লেগে গেল। তার কিছুই কান দিয়ে ঢুকে না। আমি দেখছি সবার ঠোট নড়ে, কিন্তু কিছু শুনি না। আজব অবস্থা!
১৬ ডিসেম্বর কাছাকাছি এলেই পত্রিকাওয়ালারা বিজয় দিবসের স্মৃতিকথা ছাপানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা কখনোই ভাবেন না, সেদিনের কথা। যথাযথভাবে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সেদিন আমরা সবাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোরের স্মৃতি হলো এলোমেলো স্মৃতি। ঘোরের কারণে তুচ্ছ জিনিসকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। মস্তিষ্ক খুব যত্ন করে তার মেমোরি সেলে তুচ্ছ জিনিসগুলো রেখে দেয়। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সে অদরকারি মনে করে ফেলে দেয়।
একজন মাতালকে নেশা কেটে যাবার পর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, নেশা করার ঐ রাতে তুমি মদ্যপান ছাড়া আর কী করেছিলে? সে পরিষ্কার কিছু বলতে পারবে না। বলতে পারার কোনো কারণ নেই। বিজয় দিবসে আমরা সবাই এক প্রচণ্ড নেশার মধ্যে ছিলাম। কাজেই, হে পত্রিকা সম্পাদক, আপনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। জিজ্ঞেস করলেই আমরা উল্টাপাল্টা কথা বলবো। আপনার ধারণা হবে আমরা মিথ্যা কথা। বলছি। কিন্তু আমরা কেউ মিথ্যা বলছি না। দেশের স্বাধীনতা নিয়ে কি আর মিথ্যা গল্প করা যায়?
আজ আমি বিজয় দিবসের স্মৃতির গল্প করবো না। আমি বরং আমার বাবাকে নিয়ে একটি গল্প বলি। এই মহান ও পবিত্র দিনে গল্পটি বলা যেতে পারে।
আমার বাবার এক জোড়াই জুতা ছিল। লাল রঙের চামড়ার জুতা। মাল্টিপারপাস জুতা। সাধারণভাবেও পরতেন, আবার তার পুলিশের ইউনিফর্মের সঙ্গেও পরতেন। জুতা জোড়ার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত, কারণ আমাদের প্রায়ই তার জুতা কালি করতে হতো। কাজটা আমাদের খুব পছন্দের ছিল। জুতার কালির গন্ধটা খুব মজা লাগতো। আবার ব্রাশ ঘষতে ঘষতে জুতা যখন ঝকঝকে হয়ে উঠতো, তখন দেখতে ভালো লাগতো। সবচেয়ে বড় কথা–ঝকঝকে জুতা দেখে বাবা বলতেন, আরে বাপ রে, একেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছে। এই বাক্যটি শুনতেও বড় ভালো লাগতো।