হলের সঙ্গেই কি বিশাল দীঘি! কি পরিষ্কার টলটলে পানি! বাধানো ঘাট। কত জোছনার ফিনকি ফোটা রাতে আমি আমার ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে নেমে গেছি। দীঘিতে। এই দীঘিতেই তো বড় মেয়েকে সঁতার শেখালাম। প্রথম সঁতার শিখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আমার মেয়ে একা একা মাঝ পুকুরের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার ভয় পেয়ে ফিরে এল। কি সুন্দর দৃশ্য!
হলের সামনের মাঠে আমার তিন কন্যা সাইকেল চালাতে শিখলো, আমি তাদের ইন্সট্রাকটার। সাইকেল নিয়ে প্রথমবারের মত নিজে নিজে কিছু দূর এগিয়ে যাবার আনন্দের কি কোন সীমা আছে? না নেই। এই আনন্দ আকাশ থেকে প্যারাটুপারের প্রথম ঝাঁপ দেয়ার আনন্দের মত। আমার কন্যাদের আনন্দের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই হল।
হলের বাসার টানা বারান্দায় বসে রাত জেগে কত লেখালেখি করেছি। গুলির শব্দে মাঝে মাঝে লেখায় যেমন বাধা পড়েছে তেমনি অন্যরকম ব্যাপারও ঘটেছে। হঠাৎ শোনা গেল–বাশি বাজছে। কাঁচা হাতের বাজনা না, বড়ই সুন্দর হাত। লেখালেখি বন্ধ করে বাঁশি শুনেছি।
আমার হলের নিশিরাতের সেই বংশীবাদক জানে না আমি কত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম তার বাশির জন্যে। সে ভাল থাকুক, তার জীবন মঙ্গলময় হোক–এই প্রার্থনা। কত আনন্দ পেয়েছি তার জন্যে!
সেই হল ছেড়ে দেবার সময় হল। বহু দূর প্রোথিত এই শিকড় ছিঁড়তে হবে।
কি কষ্ট! কি কষ্ট!!
ঠিক করলাম, একদিনে হল ছেড়ে যাব না। ধীরে ধীরে যাব। প্রথম দিন হয়তো বইগুলি নেয়া হবে, দ্বিতীয় দিনে শুধু চেয়ার, তৃতীয় দিনে ফুলের টব… এইভাবে এক মাসের পরিকল্পনা। বোঝাও যাবে না। আমরা হল ছাড়ছি। করাও হল তাই। বাচ্চাদের আগে আগে পাঠিয়ে দেয়া হল। আমি এবং আমার স্ত্রী হল ছাড়লাম এক গভীর রাতে।
শেষবারের মত শূন্য ঘরে দাঁড়িয়েছি। ছোট বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে কাঁদছি, গুলতেকিন বলল, তোমরা যখন এত খারাপ লাগছে তখন হল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? থেকে যাও।
থেকে যাও বললেই থেকে যাওয়া যায় না। প্রোথিত শিকড় ছিঁড়তে হয়। হয়ত এই শিকড় ছেঁড়ার মধ্য দিয়েই কেউ একজন আমাদের আসল শিকড় ছেঁড়ার কথা মনে করিয়ে দেন…
সমুদ্র বিলাস
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে আমি ছোট্ট একটা ঘর বানাচ্ছি। পৃথিবী নামক এই গ্রহে নিজের জায়গা বলতে এইটুকু। কেন এই কাজটা করলাম? ব্যাপারটা কি তাৎক্ষণিক? হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসা?
আমরা সব সময় বলি–হুট করে কিছু না ভেবে কাজটা করেছি। ব্যাপারটা মনে হয় সে রকম নয়। মানুষ কখনোই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করে না। তার প্রতিটি তাৎক্ষণিক কাজের পেছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে। এই প্রস্তুতি অবচেতন মনে হয়। সে তার খবর রাখে না।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব নড়বড়ে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসাবে সব মিলিয়ে সাতশ-টাকা বেতন। বিরাট সংসার, ছজন ভাইবোন এবং মা। আমার বেতন এবং বাবার সামান্য পেনশন আমাদের সম্বল। এই দুয়ের যোগফল এক হাজার টাকার মত। এই টাকায় এত বড় সংসার টেনে নেয়া সম্ভব নয়। এই অসম্ভব কাজটি করতেন আমার মা কিভাবে করতেন তিনিই জানেন। মাসের শেষের কটি দিন খুব কষ্টে যেত। আমার পকেট শূন্য। মনের আনন্দে আমি যে এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরাব সে উপায় নেই। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে, ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে শ্যামলীর বাসায় ফিরেছি হেঁটে হেঁটে। রিকশা নেবার সামর্থ নেই। গাদাগাদি ভিড়ে বাসে ওঠাও সম্ভব নয়।
এই অবস্থায় একটা ঘটনা ঘটল। মাসের পঁচিশ তারিখে হঠাৎ করেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা আমাকে নগদ তিনশ টাকা দিয়ে দিল। বিচিত্রা ঈদ সংখ্যায় অচিনপুর নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। এই টাকাটা তার সম্মানী। আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়, কি করব এই টাকাটা দিয়ে?
ইউনিভার্সিটি তখন বন্ধ। ক্লাসে যাবার তাড়া নেই। আমি ঠিক করলাম, ঘুরে। বেড়ানো যাক। কোথায় যাব তা ঠিক করা গেল না। টিকিট কেটে চিটাগাং মেইলে উঠে বসলাম। চিটাগাং আগে পৌঁছানো যাক–তারপর দেখা যাবে। সমুদ্র, পর্বত, অরণ্য অনেক কিছুই দেখার আছে। একটা বেছে নিলেই হবে।
সমুদ্র জয়ী হল। সন্ধ্যাবেলা কক্সবাজার পৌঁছলাম। ভাল হোটেল বলতে তখন হোটেল সায়েমান। তার ভাড়া সে সময়ে কম হলেও আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কক্সবাজারে অনেক সরকারী রেস্ট হাউস আছে। কিন্তু সেসব রেস্ট হাউস সরকারি কর্মকর্তা এবং ভিআইপিদের জন্যে। আমি সরকারি কর্মকর্তা নই, ভিআইপিও নই। সামান্য একজন শিক্ষক।
খুঁজে পেতে সস্তার একটা হোটেল বের করলাম। যার বিছানা নোংরা, বালিশ নোংরা, মেঝে বালিতে কিচকিচ করছে। কমন বাথরুম। অনেকখানি হেঁটে বাথরুমের কাছাকাছি যাবার পর টের পাওয়া যায়–ভেতরে একজন বসে আছে। সেই বাথরুমও বিচিত্র। দরজায় হুড়কো নেই, দড়ি লাগানো আছে। ভেতরে বসে শক্ত করে দড়ি টেনে রাখতে হয়। কারও পায়ের শব্দ পেলে কেশে জানান দিতে হয়–আছি, আমি আছি। রাতে মশারি দেয়া হল না। হোটেলের মালিক বললেন, সাগরের হাওয়ায় মশা থাকে না। মশারি লাগবে না। তার কথায় বিশ্বাস করে ঘুমুতে গেলাম। দেখা গেল, মশা শুধু যে আছে তাই না, প্রবলভাবেই আছে। সমুদ্রের স্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণে মশারা। সবাই স্বাস্থ্যবতী। স্বাস্থ্যবতীরা ঝাঁক বেঁধে এসে আমাকে কামড়াতে লাগল। স্বাস্থ্যবতী মশা বলার উদ্দেশ্য–স্ত্রী মশারই মানুষের রক্ত খায়, পুরুষরা না। তসলিমা নাসরিন আবার যেন মনে না করে বসেন যে, আমি মহিলা মশাদের ছোট করার জন্যে এই কথা লিখছি। এটা একটা বৈজ্ঞানিক সত্য।