একুশ লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেললাম এক মাসের মধ্যে।
একুশ লক্ষ টাকা?
সামান্য কম, তবে একশ লক্ষ ধরতে পারেন। বাংলাদেশ বিমান দিল দুজনের বোম্বে যাবার ফ্রি টিকেট। বোম্বে অবশ্যি যাওয়া হল না মেয়েটা তার আগেই মারা গেল।
ভদ্রলোক সিগারেট ধরালেন। কোন কথা না বলে অনেকক্ষণ সিগারেট টানলেন। ঘড়ি দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন–আপনার দশ মিনিট সময় নেব বলেছিলাম, পনের মিনিট নিয়ে ফেলেছি। দয়া করে ক্ষমা করবেন। গল্পটা শেষ করেছি। এখন চলে যাব। গল্পের শেষটা বলা হয়নি–শেষটা হচ্ছে–আমার একাউন্টে এখন বাইশ লক্ষ টাকার মত আছে। ইন্টারেস্ট জমা হচ্ছে, টাকা বাড়ছে। মাঝে মাঝে ভাবি–টাকাটা কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করি, কোন সেবা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেই। দিতে পারি না। লোভ আমাকে বাধা দেয়। আবার নিজেও খরচ করতে পারি না। অদ্ভুত একটা অবস্থা। এখন আমার কাজ কি জানেন? কাজ হচ্ছে প্রতি মাসে গিয়ে ব্যাংকে খোঁজ নেয়া–ইন্টারেস্ট কত হয়েছে। তিশ বছর পর কুড়ি লক্ষ টাকা কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টে কত হবে জানতে চান? বলব?
শিকড়
মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা শহরে খাট, মিটসেফ, চেয়ার-টেবিল এবং লেপ-তোষক বোঝাই করে কিছু ঠেলাগাড়ি চলাচল করে। ঠেলাগাড়ির পেছনে পেছনে একটা রিকশায় বসে থাকেন এইসব মালামালের মালিক। তাঁর কোলে থাকে চাদরে মোড়া বার ইঞ্চি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি কিংবা টু-ইন-ওয়ান। তাকে খুবই ক্লান্ত ও উদ্বিগ্ন মনে হয়, কারণ একইসঙ্গে তাকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে ঠেলাগাড়ির দিকে এবং তার কোলে। বসানো পরিবারের সবচে মূল্যবান সামগ্রীটির দিকে। তাকে খুব অসহায়ও মনে হয়। অসহায়, কারণ এই মুহূর্তে তার কোন শিকড় নেই। শিকড় গেড়ে কোথাও না বসা। পর্যন্ত তার অসহায় ভাব দূর হবে না।
মানুষের সঙ্গে গাছের অনেক মিল আছে। সবচে বড় মিল হল, গাছের মত মানুষেরও শিকড় আছে। শিকড় উপড়ে ফেললে গাছের মৃত্যু হয়, মানুষেরও এক ধরনের মৃত্যু হয়। মানুষের নিয়তি হচ্ছে তাকে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয় চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে।
শিকড় ছড়িয়ে দেবার জন্যে গাছের অনেক কিছু লাগে–নরম মাটি, পানি, আলো, হাওয়া। মানুষের কিছুই লাগে না। কয়েকটা দিন একটা জায়গায় থাকতে পারলেই হল, সে শিকড় গজিয়ে ফেলবে এবং অবধারিতভাবে শিকড় উপড়ানোর তীব্র যাতনায় এক সময় কাতর হবে। দৃশ্যটা কেমন? একটা পরিবারের কথাই মনে করা যাক। ধরা যাক, এরা চার-পাঁচ বছর একটা ভাড়া বাড়িতে থেকেছে। বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালাদের স্বভাবমত এদের নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। ঠিকমত পানি দেয়নি। বাড়িভাড়া বাড়িয়েছে দফায় দফায়, শেষ পর্যন্ত নোটিশ দিয়েছে বাড়ি ছাড়ার। এরা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। নতুন একটা বাড়ি পেয়েছে, যেটা এই বাড়ির চেয়েও সুন্দর। ভাড়া কম, সামনে খানিকটা খোলা জায়গাও আছে। পরিবারের সবাই এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, এই পচা বাড়ি ছেড়ে দিতে পেরে তারা খুবই আনন্দিত। কিন্তু পরিবারের কত্রী মনের কষ্ট পুরোপুরি ঢাকতে পারছেন না। বারবারই তার মনে হচ্ছে, এই বাড়ি ঘিরে কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি।
তাঁর বড় ছেলের জন্ম হলো এই বাড়িতে। এই বাড়িতেই তো সে হাঁটতে শিখল। টুকটুক করে হাঁটতো, একবার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে কি প্রচণ্ড ব্যথাই না পেল। প্রথম কথা শিখে পাখি দেখে উত্তেজিত গলায় বলেছিল, পা… পা… পা…
তিনি বাধাছাদা করছেন, পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে আর চোখ মুছছেন। জিনিসপত্র সরাতে গিয়ে বাবুর ছমাস বয়সের একটি জুতা পেয়ে গেলেন। বাবু বেঁচে নেই, তার সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মৃতের কিছু জমা করে রাখতে নেই। কিন্তু তার একপাটি জুতা কিভাবে থেকে গেল? এই জুতায় এখনো বাবুর গায়ের গন্ধ।
তিনি ঘর গোছানো বন্ধ রেখে স্বামীকে নিচু গলায় বললেন, কিছু বেশি ভাড়া দিয়ে থেকে গেলে কেমন হয়? স্বামী খুব রাগ করলেন। কি আছে এই বাড়িতে যে এখানেই থাকতে হবে? এ বাড়ি নরক ছাড়া আর কি? নচ্ছার বাড়িওয়ালা। বাসা ছোট। আলো নেই, বাতাস নেই।
যেদিন বাসা বদল হবে সেদিন ছোট বাচ্চা দুটা কাঁদতে লাগলো। তারা এই বাসা ছেড়ে যাবে না। বাবা হুংকার দিলেন, খবরদার, নাকি কান্না না। এরচে হাজার গুণ ভাল বাসায় তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।
বাবা জিনিসপত্র ঠেলাগাড়িতে তুলে বাসার চাবি বাড়িওয়ালাকে দিতে গেলেন। চাবি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িতে তার প্রোথিত শিকড় ছিড়ে গেল। তীব্র কষ্টে তিনি অভিভূত হলেন। তাঁর চোখে পানি এসে গেল। নতুন বাসার জন্যে এডভান্স টাকা দেয়া হয়ে গেছে। তার মত দরিদ্র মানুষের জন্যে অনেকগুলি টাকা। তারপরেও তিনি বাড়িওয়ালাকে বললেন, ভাই সাহেব, ছেলেমেয়েরা এই বাসা ছাড়তে চাচ্ছে না। চারদিকে পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা তো… আচ্ছা না হয় পাঁচশ টাকা বেশিই দেব… তাছাড়া ইয়ে, মানে আমার বড় ছেলে এই বাড়িতেই জন্মাল, আমার স্ত্রী মানে। মেয়েমানুষ তো, ইমোশনাল, বুঝতেই পারছেন না… ছেলের স্মৃতি…,
বাড়িওয়ালা রাজি হলেন না। বাবা ভেজা চোখে ছোট্ট টিভিটা কোলে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলেন।
অনেকদিন ধরেই আমি এই শহরে আছি। কতবার বাসা বদলালাম। প্রতিবারই এই কাণ্ড। বছরখানিক আগে শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের বাসাটা ছাড়লাম। অনেকদিন সেখানে ছিলাম। কত সুখস্মৃতি! বাসার সামনেটা গাছগাছালিতে ছাওয়া। গাছে বাসা বেঁধেছে টিয়া। একটি দুটি না–হাজার হাজার। বারান্দায় বসে দেখতাম, সন্ধ্যা হলেই ঝাক বেঁধে টিয়া উড়তো। আমার মেয়েরা গাছের নিচে ঘুরঘুর করতো টিয়া পাখির পালকের জন্যে। এরা পাখির পালক জমাতো।