বর্তমান সময়ের একটাই বোধহয় স্লোগান–চুপ করে থাকো। আমরা চুপ করে থাকব। আমরা কথা বলতে পারব না।
কিন্তু আর কতদিন?
একটা কিছু করার সময় কি আসেনি?
বলা হয়ে থাকে, যে একবার বন্দুক হাতে নেয়, সে হাত থেকে বন্দুক নামাতে পারে না। বন্দুক নামালেই তার জীবন সংশয়। এই ব্যাপারটিও না হয় ভেবে দেখা যাক। ভুল পথে যাওয়া যুবশক্তিকে কাজে লাগানোর পথ খোঁজা যাক। সমাজবিদরা ভেবে দেখুন, কি করলে এরা ঠিক হবে। শাস্তির ভয়ে এরা কাবু হবার নয়। জীবন-মৃত্যু খেলা যারা খেলে, তারা এত সহজে ভড়কায় না। এদের জন্যে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই ভাবনা সবাই মিলে ভাববেন, এটা আশা করা অন্যায় নিশ্চয়ই নয়।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি–সবার জন্যে স্বাস্থ্য, সবার জন্যে শিক্ষা–… খুব ভাল। কথা, কিন্তু সবচে জরুরী কথা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা। সেই নিশ্চয়তা সম্পর্কে কঠিন পদক্ষেপ কি আমরা কোনদিন নেব না?
পুলিশ অফিসার ফরহাদ সাহেবের মৃত্যুর পর সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জেনে আনন্দিত হলাম। শোক প্রস্তাব নিতে তো এখন ঘেন্না লাগার কথা! শোক প্রস্তাবের বাইরে আমরা কি করছি? আসলেও কিছু করার ইচ্ছা কি আমাদের আছে?
নিহত পুলিশ অফিসারের সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুসন্তানটির মায়াকাড়া মুখ দেখে বেদনায়। অভিভূত হয়েছি। এই ছেলেটি বড় হয়ে যখন প্রশ্ন করবে–কারা মারল আমার বাবাকে? কেন মারল? তখন আমরা কি জবাব দেব?
দেশে এখন জনগণের নির্বাচিত সরকার। এই সরকারের কাছে আমাদের অনেক দাবি, অনেক প্রত্যাশা। কারণ আমরা এই সরকারকে নির্বাচিত করেছি। সরকারের কাছে আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাইছি। জানি, এই কাজ সহজ নয়। সরকারের হাতে আলাদীনের যাদুপ্রদীপ নেই–কিন্তু সৎ ইচ্ছা যাদুপ্রদীপের চেয়েও কার্যকর। সৎ ইচ্ছা নিয়ে এগুতে হবে।
আমরা বিভিন্ন জায়গায় ধূমপানমুক্ত এলাকা ঘোষণা করছি–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্ত্রমুক্ত এলাকা ঘোষণার ব্যাপারটা কি ভাবা যায় না? সমগ্র দেশের সবচে নিরাপদ এলাকা হওয়া উচিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আজকাল সন্ধ্যার পর সেই এলাকায় রিকশা যেতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসাবে এই দুঃখ, এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি?
আমার কাছে একটি প্রাণের মূল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দশটি শিক্ষাবর্ষের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি। একটি প্রাণ নষ্ট হবার আশংকা যদি থাকে, তাহলে বন্ধ থাকুক বিশ্ববিদ্যালয়। ধরে নিতে হবে, আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি হইনি। একদিকে বোমা ফুটবে, গুলি হবে, ছাত্র মরবে, অন্যদিকে আমরা নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্লাস করতে থাকব, এ কেমন কথা? আমরা কোথায় চলেছি।
ভূতদের পা থাকে উল্টো দিকে। তারা চলে উল্টো পথে। আমরা ভূত না, আমরা মানুষ। আমরা ভূতের মত উল্টো পায়ে হাঁটতে পারি না। অথচ অনেকদিন ধরেই উল্টোপায়ে হাঁটছি। কেন? কেন? কেন?
মৃত্যু
তার পেটে ক্যানসার। দুবার অপারেশন হয়েছে। প্রথমবার দেশে, দ্বিতীয়বার কোলকাতায়। লাভ কিছু হল না। অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো। তাকে নিয়ে। যাওয়া হলো ব্যাঙ্ককের আমেরিকান হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসা না-কি ভাল। অনেক সময় এমন হয়েছে, দেশের ডাক্তাররা বলেছেন ক্যানসার—ওখানে গিয়ে দেখা গেছে অন্য কিছু।
তিনিও হয়ত তেমন কিছু আশা করছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্ককের ডাক্তাররা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শুধু যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টাই করা যাবে। আর কিছু না।
তিনি হতভম্ব হয়ে ডাক্তারদের কথা শুনলেন। পাশে দাঁড়ানো তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে নেত্রকোনার ডায়ালেক্টে বললেন–নাক চেপ্টা ডাক্তার, এইতা কি কয়?
ছেলে বলল, বাবা, তুমি কোন চিন্তা করবে না। আমি তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। যে চিকিৎসা কোথাও নেই–সেই চিকিৎসা আমেরিকায় আছে।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, গাধার মত কথা বলিস না। আমেরিকার মানুষ বুঝি ক্যানসারে মরে না? চল দেশে যাই। মরণের জন্য তৈয়ার হই।
ভদ্রলোক মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।
গল্প-উপন্যাসে এরকম চরিত্র পাওয়া যায়। অমোঘ মৃত্যুর সামনেও দেখা যায় গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা নির্বিকার থাকে। একটা হিন্দী ছবিতে দেখেছিলাম, নায়ক জানতে পেরেছে ক্যানসার হয়েছে। অল্প কিছুদিন বাঁচবে। জানবার পর থেকে তার ধেই ধেই নৃত্য আরো বেড়ে গেল। কথায় কথায় গান। কথায় কথায় হাসি।
বাস্তব কখনোই সেরকম নয়। বাস্তবের অসীম সাহসী মানুষও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারেন না। মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করা তো অনেক দূরের ব্যাপার —
আমরা বেঁচে থাকতে চাই। শুধুই বেঁচে থাকতে চাই। যখন শেষ সময় উপস্থিত হয় তখনো বলি–দাও দাও। আর একটি মুহূর্ত দাও। দয়া কর।
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে।
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
(আট বছর আগে একদিন)।
যে জীবনের জন্যে আমাদের এত মোহ, এত ভালবাসা, সেই জীবনটা যে কী তাই কি আমরা জানি? নিঃশ্বাস নেয়া, খাওয়া এবং ঘুমানো? না কি তার বাইরেও কিছু?
তত্ত্বকথায় না গিয়ে আগের জায়গায় ফিরে যাই। যে ভদ্রলোকের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার কাছে যাওয়া যাক। ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন। প্রাইভেট কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। তাঁর সারাজীবনই কষ্টে কষ্টে গেছে। শেষ সময়ে একটু সুখের। মুখ দেখলেন। একজন ছেলে সরকারী কলেজে শিক্ষকতার কাজ পেল। আরেক ছেলে ব্যবসাতে ভাল টাকা পেতে লাগল। একমাত্র মেয়েটি মেডিক্যাল কলেজে ফোর্থ ইয়ারে আছে–। এমন সুখের সময় সব ছেড়ে ছুটে চলে যাবার চিন্তাটাই তো অসহনীয়।