আমাদের টিম অত্যন্ত ভাল খেলেছে। পাসের আদান-প্রদান এবং দলীয় সমঝোতা ছিল অসাধারণ পর্যায়ের। আমরা প্রতিপক্ষকে বেশিরভাগ সময়ই কোণঠাসা করে রেখেছিলাম। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তারা ছিল প্রবল চাপের মুখে। আমরা যে পরাজিত হয়েছি তা নিতান্তই ব্যাড লাক। আমরা আসলে ভাল খেলে পরাজিত। তবে। এই পরাজয় বৃথা যায়নি। পরাজয় থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করেছি। সে শিক্ষা ভবিষ্যতে বিদেশের মাটিতে জয়লাভ করতে আমাদের সাহায্য করবে।
পরাজয়ের শিক্ষা মনে হয় তেমন কাজে আসে না। কাজে এলে অসংখ্য পরাজয় থেকে এরইমধ্যে আমরা অনেক কিছু শিখে ফেলতাম। কিছু শিখতে পারিনি। পারব এমন লক্ষণও দেখছি না।
তারপরেও আমরা ফুটবল ভালবাসি। বাঙালী বাবারা তাদের পুত্রদের প্রথম যে খেলনা কিনে দেন তার নাম ফুটবল। কেন?
আজ পত্রিকায় দেখলাম–পলিটেকনিকের ছেলেরা ওয়ার্ল্ড কাপের সময়। পরীক্ষা পড়েছে এই রাগে তাদের কলেজের চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা সব ভেঙে একাকার করেছে। ভালবাসা নামক এই অবসেসানের কারণ কি?
মনস্তত্ত্ববিদরা কারণ হয়ত জানেন। আমার নিজের ধারণা আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানিকের জন্যে উত্তেজিত হতে ভালবাসি। উপদেশ এবং গালি দিতে পারলে আমাদের খুব আনন্দ হয়। খেলার মাঠে যত ইচ্ছা উপদেশ এবং দেয়া যায়। নমুনা—
কানা তুই দেখস কি? পাস দে। তোর বাপের বল, পায়ের চিপায় রেখে দিয়েছিস?
(শব্দটা পায়ের চিপা নয়, অন্য এক স্থান। শালীনতার কারণে পায়র চিপা বললাম। বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নিন)।
ল্যাং মার। ল্যাং মার। আরে কুত্তার বাচ্চা, ল্যাং মেরে ফেলে দে না।
ভ্যাবদা মেরে বসে আছিস ক্যান রে চান্দি ছোলা? শট দে। শট দেয়া ভুলে গেছিস?
(এই খেলোয়াড়ের মাথায় চুল কম বলেই আদর করে চান্দি ছোলা বলা হচ্ছে)।
ঐ শুওরের বাচ্চার চোখ তুলে ফেল।
চামড়া ছিলে লবণ মাখিয়ে দে।
টান মেরে–ছিঁড়ে ফেল।
(কি ছিঁড়তে বলা হয়েছে পাঠক বুঝে নিন)।
খেলা শেষ হবার পরপর রেফারিকে ধোলাই দেয়ার একটা ব্যাপার চলে আসে। নূতন কোন ব্যাপার না। আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। বাঙালী রেফারিরা এতে কিছু মনেও করে না। ধোলাই খাওয়াটাকে তারা কপালের লিখন হিসাবে মেনে নিয়েছে। অবশ্যি রেফারিকে ধোলাই দেয়ার এই প্রবণতা শুধুমাত্র বাঙালী জাতির বৈশিষ্ট্য নয়, এটা সর্বজনীন। পাঞ্চ পত্রিকায় একটা কার্টুন দেখেছিলাম। কার্টুনে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে একটা বেড সাজানো হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হয় ব্যাপার কি? হাসপাতালের এটেনডেন্ট বলল, আজ ফুটবল খেলা আছে না? এই বেড় রেফারির জন্যে।
যাই হোক, চার বছর পর আবার আসছে ওয়ার্ল্ড কাপ। এই সময়ের সবচে বড় ঘটনা এবং আশ্চর্যজনক ঘটনা।
বাতাস ভর্তি চামড়ার একটি গোলকের দিকে সারা পৃথিবীর মানুষ তীব্র উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে–এর চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার আর কি হতে পারে? আমরা বাঙালীরা খেলা দেখতে দেখতে কিছু সময়ের জন্যে হলেও আমাদের শৈশবে ফিরে যাব। তার মূল্যও বা কম কি? ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। আমরা ভিজে ন্যাতা ন্যাতা। বৃষ্টিভেজা। মাঠে জাম্বুরা নিয়ে আমরা দৌড়াচ্ছি। পায়ের নিচে পানি ছপ ছপ করছে। কে যেন। গড়িয়ে পড়ল কাদায়। পড়ুক। দেখার সময় নেই। বল নিয়ে দৌড়াতে হবে। ঐ তো দেখা। যায় গোল পোস্ট।*
———-
* ফুটবল নিয়ে এই সংকলনে আরেকটি লেখা আছে। লেখাটার শিরোনাম খেলা। দুটি লেখার মূল বিষয় একই। একটা লেখা রাখলেই চলত, তবু দুটাই রেখে দিলাম।
বাউলা কে বানাইলরে
তিনি ছিলেন একজন ছোটখাট রাজা, অসম্ভব ক্ষমতাবান এক সামন্ত প্রভু। সামন্ত প্রভুদের অনেক বিচিত্র স্বভাব থাকে, তারও ছিল। গভীর রাতে তিনি রূপবতী। সঙ্গিনীদের নিয়ে বজরায় উঠতেন। বজরা নিয়ে যাওয়া হত মাঝ হাওড়ে। যেন। আশপাশে কেউ না থাকে। যেন তার বিচিত্র নিশিযাপন কেউ বুঝতে না পারে। শুরু হত গান। এক পর্যায়ে তিনি তার সঙ্গিনীদের বলতেন নাচতে। শুরু হত নাচ। প্রবল। তামসিক জীবন। শুধু ভোগ, শুধুই আনন্দ। এই তামসিক জীবন যিনি যাপন করে গেছেন তার নাম হাসন রাজা। ভয়াবহ তৃষ্ণা নিয়ে জীবনকে তিনি পান করেছেন। তারপরেও তৃষ্ণা মেটে না। ভোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গেয়েছেন, বাউলা কে বানাইলরে, হাসন রাজারে?
হাসন রাজার প্রপৌত্র কবি মমিনুল মউজদীন আমাকে সুনামগঞ্জে যাবার আমন্ত্রণ। জানালেন। সুনামগঞ্জের মানুষ হাসন রাজাকে নিয়ে উৎসব করছেন। রাতভর তারা। শোনাবেন হাসন রাজার গান। কবি মমিনুল চাচ্ছেন আমি যেন সেই উৎসবে থাকি। একবার ভাবলাম, যাব না। উৎসব মানেই হৈ-চৈ। তাছাড়া আমাকে সেখানে নিশ্চয়ই বক্তৃতাও দিতে হবে। কি বলব আমি? হাসন রাজার গান শুনেছি–এই পর্যন্তই। আর কিছুই জানি না। বক্তৃতা দেয়ার জন্যে বিদগ্ন বক্তারা তো থাকবেনই। তারা মিসটিক কবি সম্পর্কে অনেক কিছু বলবেন। শুরুটা হবে মিসটিক শব্দের ব্যুৎপত্তি থেকে। গ্রীক কোন শব্দ থেকে এসেছে, এর সাধারণ মানে কি, আবার অসাধারণ মানে কি? দার্শনিক হিসেবে হাসন রাজার শ্রেণীভেদ করা হবে। তার সহজ প্রেমের গানগুলি যে। আসলে আধ্যাত্মিক গান, তা কঠিন সব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা হবে। ১৯৩১ সনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে The Religion of Man প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজার গান। বিষয়ে কি বলেছিলেন তা বলা হবে। হংসসম এই সব পণ্ডিত বক্তাদের মাঝে আমি তো দলছুট বক। আমি কি করব?