একজন বড়ো লেখককে মানুষ হিসেবেও বড়ো হতে হয়। হক ভাই মানুষ হিসেবে বড়ো কিনা আমি জানি না, তেমন ঘনিষ্ঠভাবে তার সঙ্গে মেশার সুযোগ আমার হয়নি, তারপরেও দুটি ক্ষুদ্র ঘটনার উল্লেখ করছি–
কবি শামসুর রাহমান সাহেব তখন খুব অসুস্থ। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফুসফুসে পানি জমে গেছে। জীবন সঙ্কটাপন্ন। আমি দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখতে গিয়েছি। কবিকে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, তখন এলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি কবির কাছে দাঁড়ালেন। তার একটি হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপর রাখলেন এবং বললেন, আমি সবার সামনে এই প্রার্থনা করছি–আমার আয়ুর বিনিময়ে হলেও আপনি যেন বেঁচে থাকেন।
বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না, ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আমি দেখলাম, সৈয়দ হক কাঁদছেন। আজ শুনতে পাই দুজনের সম্পর্কের খুব অবনতি হয়েছে। একে অন্যের নাম পর্যন্ত শুনতে পারেন না। তারপরেও আমি নিশ্চিত জানি, আবারো যদি কবি অসুস্থ হন–সৈয়দ হক ছুটে যাবেন এবং কবির রোগমুক্তি প্রার্থনা করবেন।
এবার দ্বিতীয় ঘটনাটা বলি–আমি তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হলো। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। ভয়াবহ শারীরিক কষ্ট। হক ভাই কার কাছ থেকে আমার অসুখের খবর শুনলেন। শোনামাত্র ছুটে এলেন আমার বাসায়। বিছানায় আমার পাশে বসে কঠিন গলায় বললেন–হুমায়ূন, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে এবং অনেক দিন বেঁচে থাকতে হবে। তোমার হাতে ছয়টি আঙুল। এই ছটি আঙুলের একটি হলো কলম। ছআঙুলি মানুষের অসুস্থ হওয়া চলে না।
হক ভাইয়ের সুন্দর করে বলা এই বাক্য দুটি আমার অনেক সঞ্চয়ের একটি। মাঝে মাঝে সমালোচকদের কঠিন আক্রমণে যখন দিশেহারা হয়ে যাই তখন নিজের ডান হাত চোখের সামনে মেলে ধরে বলি–আমার হাতে ছটি আঙুল। ছ-আঙুলি মানুষদের দিশেহারা হলে চলে না।
ভোরের কাগজ হক ভাইয়ের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করছে শুনে খুব। ভালো লাগছে এই কারণে যে, আমি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।
হক ভাই, আপনি ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন–আপনার প্রতি এই আমার শুভ কামনা। আপনি অতি ভাগ্যবান। জীবন তার মঙ্গলময় হাতে আপনাকে স্পর্শ করেছে–এই বিরল সৌভাগ্য কজনের হয়?
ফুটবল ও আমরা
চার বছর আগে কথা। অয়োময় ধারাবাহিক নাটকের চিত্রায়ন হচ্ছে ময়মনসিংহের রাজবাড়িতে। ক্যামেরা নিয়ে সবাই বসে আছি। শিল্পীরা তৈরি। পরিচালক নওয়াজিশ আলী খান এ্যাকশান বললেই অভিনয় পর্ব শুরু হবে। এমন সময় ঝামেলা শুরু হল। মিছিলের প্রচণ্ড শ্লোগানে চারদিক কাঁপতে লাগল। আমাদের দেশটা মিটিং-মিছিলের দেশ। শ্লোগান কোন নতুন ব্যাপার না। কিন্তু সেদিনের মিছিলের শ্লোগান অতি বিচিত্র। সাধু ভাষায় বলা যেতে পারে অশ্রুতপূর্ব। শ্লোগান হচ্ছিল–ওয়ার্ল্ড কাপ সিদ্ধান্ত! মানি না। মানি না। আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন! করতে হবে, করতে হবে।
নওয়াজিশ আলী খান বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তাকে বললাম–লোকজন আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন না হওয়ায় ক্ষেপে গেছে। এই জন্যেই মিছিল, শ্লোগান, আন্দোলন।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, আন্দোলন করে লাভ কি? আমি বললাম, আমরা। ময়মনসিংহের লোক, আমরা লাভ-লোকসান বিচার করে আন্দোলন করি না। আমাদের ফেবারিট টিম আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনা হেরে যাবে আর আন্দোলন করব না, তা হয় না।
নাটকের ইউনিটের সবাই কৌতূহলী হয়ে মিছিল দেখতে গেল। বিশাল জঙ্গী মিছিল। গলায় রুমাল বাধা এক যুবক আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে–আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন না বানালে —
বাকি সবাই ধুয়া ধরছে,–জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
নওয়াজিশ আলী খান বিনীত ভঙ্গিতে জানালেন যে, তিনি এই জীবনে অনেক পাগল দেখেছেন। ময়মনসিংহের লোকের মত পাগল দেখেননি।
কি এই ঘটনা আমি জাতিগতভাবে বাঙালীর ফুটবল প্রীতির নমুনা হিসাবে উপস্থিত করলাম। সাম্প্রতিক আরেকটি নমুনা দিচ্ছি। ডামফা কাপ ফাইনাল কিছুদিন আগে হয়ে। গেল। আবাহনীর হয়ে খেলছেন ইরাকী খেলোয়াড় নজর আলী। তিনি গোল করলেন। টিভিতে এই দৃশ্য দেখে এক দর্শক নজর আলী বলে বিকট চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন। দ্বিতীয় দিনও তার জ্ঞান ফেরেনি। এই খবর পত্রিকার মারফতে আমি জানি। ও আচ্ছা, আরেকটি ঘটনা মনে পড়েছে। গত ওয়ার্ল্ড কাপের সময় আমার এক দূর সম্পর্কের ফুপুকে বিশেষ বিশেষ খেলার দিনে রোজা রাখতে হয়েছে। ভদ্রমহিলার বয়স ষাটের কাছাকাছি। ফুটবল খেলা নিয়ে তার কোন রকম মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও নয়। তারপরেও তাকে রোজা রাখতে হয়েছে। কারণ তার ছেলের ফেবারিট টিমের খেলা। ছেলে নিজে রোজা রাখতে পারে না, কষ্ট হয়। মাকে দিয়ে রাখাচ্ছে।
আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি নয়–ফুটবল। মজার ব্যাপার হল এই ফুটবল আমরা কিন্তু খেলতে পারি না। গত সাফ গেমসে আমাদের ফুটবলাররা শরীর ফিট রাখার জন্যে এক মণ মধু খেয়ে কি খেলা খেলেছিলেন, তা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। আমাদের খেলোয়াড়রা বিদেশে খেলতে গিয়ে দশ-বারোটা করে গোল হাসিমুখে খান। আমরা দল বেঁধে এয়ারপোর্টে তাদের আনতে যাই। তারা সেখানে গম্ভীরমুখে। সাংবাদিক সম্মেলন করেন। গলাটলা কাঁপিয়ে ভাষণ দেন।