দুটা হাতি আনানো হল। প্রথমটায় ছোট মীর্জার লোকজন। দ্বিতীয়টায় লাঠিয়ালসহ ছোট মীর্জা। প্রচণ্ড রোদের ভেতর শুটিং চলছে। হঠাৎ ছোট মীর্জা আসাদুজ্জামান নূর এবং লাঠিয়াল মোজাম্মেল হোসেনের বিকট চিৎকার—ভিজিয়ে ফেলেছে। ভিজিয়ে ফেলেছে।
ব্যাপার বিচিত্র। হাতি কিছুক্ষণ পর পর তার শুড় মুখে ঢুকিয়ে এক ধরনের জলীয় পদার্থ টেনে এনে তার সারা গায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাতির মাহুত বলল, গরমের সময় হাতি এইটা করে। পেটের ভেতর থেকে পানি এনে শরীর ভিজিয়ে দেয়।
শ্যুটিং এগুচ্ছে। মহাপরাক্রমশালী ছোট মীর্জা এবং তার ভয়ংকর লাঠিয়াল কিছুক্ষণ পর পর চেঁচাচ্ছে–সর্বনাশ! আবার ভিজিয়ে দিয়েছে। পেটের ভিতর থেকে হাতি কি টেনে এনে আমাদের ভিজাচ্ছে–আল্লাহ জানেন!
হাতিকে আমরা খুব বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে জানি। অথচ মূখের উপমা দেবার সময় বলি–হস্তীমুর্খ। ব্যাপারটা মজার না? হস্তীমুর্খ কেন বলা হয় আমি বের করেছি। আপনাদের ব্যাখ্যা করে বলি।
কিছুদিন আগে আমার একজন প্রকাশক সময় প্রকাশন-এর ফরিদ আহমেদ আমাকে বলল, হুমায়ূন ভাই! শ্রীমঙ্গলে দুটা ছোট ছোট হাতির বাচ্চা আছে। হাতির ব্যাপারে আপনার তো খুব আগ্রহ, দেখতে যাবেন?
আমি বললাম, অবশ্যই যাব।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে চললাম হস্তী-শাবকের সন্ধানে। পাহাড় থেকে কাঠ কেটে নামানোর জন্যে সেখানে প্রচুর হাতি ব্যবহার করা হয়। হাতি বেচা-কেনাও হয়। একটি পরিণত বয়সের হাতির দাম পাঁচ লাখ টাকা। অল্পবয়সী হাতি তিন লাখ টাকায় পাওয়া যায়। কাঠ-টানা হাতিগুলি অমানুষিক পরিশ্রম করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঠ টানে। কোন বিশ্রাম নেই। এক দিনের পরিশ্রম বাবদ হাতির মালিক পান দুহাজার টাকা। দিনের পর দিন এই কাঠ টানা চলতে থাকে। প্রচণ্ড শক্তিধর এই প্রাণী ইচ্ছা। করলেই মাহুতকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে বনে ফিরে যেতে পারে–তা সে করে না। মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে–সে যদি মুর্খ না হয়–মুর্খ কে?
হাতির বাচ্চা দেখার জন্যে এক ভোরবেলা শ্রীমঙ্গল থেকে মাইক্রোবাসে করে রওনা হলাম। বাচ্চারা কমলা কিনে নিল হাতির বাচ্চাকে খাওয়াবে। সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা নেয়া হল। হাতির বাচ্চার গলা জড়িয়ে ধরে ছবি তোলা হবে। আমার বাচ্চাদের উৎসাহের সীমা নেই।
হাতির বাচ্চা দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। ছোটখাট একটা হাতি। সামনের দুটা পা এবং পেছনের দুপা শিকল দিয়ে বেঁধে টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। তার নড়াচড়ার শক্তি নেই। তার ঊড় নানান জায়গায় কাটা। রক্ত পড়ছে। চোখ ভেজা। সে নিঃশব্দে কঁদছে। জানা গেল, বাচ্চাকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে সে বন থেকে কাঠ টেনে আনতে পারে এই ট্রেনিং। আমি বললাম, এর বয়স কত?
মাহুত বলল, তিন বছর।
একে আপনারা মারছেন?
না মারলে শিখবে কিভাবে?
এভাবে টানা দিয়ে কতক্ষণ রাখা হয়?
মাঝে মাঝে দুদিন-তিনদিনও রাখা হয়। খাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। হাতির ট্রেনিং বড়ই কঠিন।
তিন বছর বয়েসী হাতির বাচ্চা হুংকারের মত করল। মাহুত সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে তার গুঁড়ে লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড বাড়ি বসাল। আমরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছবি হল না, ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করা হল না। মানুষ হয়ে জন্মেছি, এই লজ্জা ও এই অপমান সহ্য করে মাথা নিচু করে ফিরে চলে এলাম। মনে মনে বললাম, জগতের। সমস্ত পশু, তোমরা আমাদের মানুষ হয়ে জন্মানোর এই অপরাধ ক্ষমা করে দাও।
প্রিয় হক ভাই
হক ভাইকে প্রথম দেখি বাংলা একাডেমীতে। তখন তার মাথায় চুল ছিল, হাতে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কাকে যেন কী বলছেন। আমি পেছনের দিকে রয়েছি, কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি না। ইন্টারেস্টিং কিছু হবে–এই ভেবে কাছে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে শুনি, হক ভাই বইয়ের ভাষায় কঠিন কঠিন শব্দে জটিল সব বাক্য তৈরী করে রাগ ঝাড়ছেন। আমার মনে হলো, মানুষটা তো বেশ। রাগের সময়ও কথা ঠিক রাখছেন।
তাঁর সঙ্গে পরিচয়ও ভাসা ভাসা পরিচয়। সমস্যাটা আমার–আমি চট করে সহজ হতে পারি না। আরে হক ভাই, এতোদিন কোথায় ছিলেন? বলে গায়ের উপর পড়ে যাওয়া আমার স্বভাবে নেই। সমস্যা কিছুটা হক ভাইয়েরও কথাবার্তা বলার সময় তিনি দূরত্ব তৈরি করে এমন ভাষা ব্যবহার করেন।
যাই হোক, প্রথম পরিচয়েই আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি তার রচনার ভক্ত পাঠক। আমার এই কথায় তিনি তেমন উল্লসিত হননি। শুকনো গলায় বললেন, ও আচ্ছা।
এতে আমি খানিকটা আহত হলাম। আমার মনে হলো, তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কাজেই তার প্রচুর লেখা যে আমার পড়া সেই প্রমাণ দেবার চেষ্টা করলাম। এতেও তার তেমন উৎসাহ দেখলাম না। নিজের রচনা সম্পর্কে আলোচনা শুনতে সবাই উৎসাহী হয়, এ মানুষটা হচ্ছেন না কেন? না কি তিনি শুধু আমার প্রতিই এ ধরনের আচরণ করলেন? এই রহস্য এখনো ভেদ হয়নি।
আমি আমার অনেক লেখায় অনেক ইন্টারভ্যুতে বলেছি–সৈয়দ হক আমার প্রিয় লেখক। এ দেশের প্রধান ঔপন্যাসিক আমার মতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নন–সৈয়দ শামসুল হক। নানান কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমালোচকদের সুনজর পেয়েছেন–হক ভাইয়ের ভাগ্যে তা তেমন জোটেনি, বরং অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ টাইপদের কাছ থেকে পর্ণোগ্রাফিক লেখক আখ্যা পেয়েছেন। এই অসম্মান তার প্রাপ্য ছিল না।
একজন বড়ো লেখকমাত্রই তার লক্ষ্য ঠিক করে নেন। তারপর সেই লক্ষ্যের দিকে খুব সাবধানে এগুতে থাকেন। অনেকটা বিড়ালের নিঃশব্দ যাত্রার মতো। পাঠক বুঝতেও পারেন না লেখক তাঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। যখন বুঝতে পারেন তখন আর ফিরে আসার উপায় থাকে না। হক ভাই এই কাজটি অসম্ভব সুন্দর ভঙ্গিতে করেন। একজন বড়ো লেখক চারপাশের জগৎ অগ্রাহ্য করে নিজের কল্পনার জগতে বাস করেন না। বড়ো লেখকের এসকেপিস্ট হওয়ার পথ নেই। হক ভাই এসকেপিস্টদের একজন না, তিনি কখনোই বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি। তার নিজের আনন্দের জন্য তিনি লেখেন না–পাঠকের আনন্দও তাঁর রচনার প্রধান বিষয় নয়…। তার রচনা পাঠ করে মনে হয়, তিনি বিশ্বাস করেন তাকে একটি দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এই দায়িত্ব প্রিয় হোক অপ্রিয় হোক তাকে পালন করতেই হবে।