আমাদের পরম সৌভাগ্য, এত বড় মাপের একজন মানুষকে আমরা নিজেদের মধ্যে পেয়েছি। যিনি তাঁর প্রতিভার যাদুস্পর্শে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে একাই ১০০ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। জীবনের গভীরতম বোধকে আমাদের উপলব্ধির কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন অবলীলায়। সেই তাকে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হিসেবে কাছে না টেনে ঈশ্বর হিসেবে দূরে সরিয়ে দেয়াটা হাস্যকর ব্যাপার নয় কি? হাস্যকর ব্যাপারগুলি
আমরা এত আগ্রহ নিয়ে কেন করি?
আমি একবার মজা করে লিখেছিলাম, মানুষ হচ্ছে এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণী যে বেশিরভাগ কাজই করে বোকার মত। আজকাল প্রায়ই মনে হয়, এটাই বোধহয় সত্যি। বোকার মত কাজ করার জন্যেই হয়তো বুদ্ধিমান এক প্রাণী সৃষ্টির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
————-
** পত্রিকায় দেয়ার আগে নূরকে আমি রচনটা পড়ে শোনালাম। শুরুতে তার মুখ খুব হাসি হাসি
থাকলেও, শেষটায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, নন্দনতত্ত্ব ব্যাখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের বক্তব্য গ্রহণ করতে হবে, তা কে বলল?
প্রিয় পশু
আপনার রাশি কি?
আপনার প্রিয় রঙ কি?
আপনার প্রিয় ফুল কি?
এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব আমাকে প্রায়ই দিতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি–আপনার প্রিয় পশু কি? সম্ভবত প্রশ্নকর্তাদের মনে। কখনো আসেনি যে পশুরাও প্রিয় হতে পারে। গালি দেয়ার জন্যে পশু ব্যবহার করা হয়—পশু প্রিয় হবে কিভাবে! মানুষ ভয়ংকর কোন কাণ্ড করলে আমরা বলি—ব্যাটা নরপশু।
তারপরও সবারই বোধহয় প্রিয় পশু আছে। টিপু সুলতানের ছিল বাঘ, নিউটনের ছিল বিড়াল, যে বিড়াল জ্বলন্ত ল্যাম্প ফেলে পুড়িয়ে ফেলেছিল প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা নামের বিখ্যাত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। আমাদের দেশের বিখ্যাত এক ব্যক্তির প্রিয় পশু বানর। মাসে অন্তত একবার তিনি চিড়িয়াখানায় যান এবং হা করে বানরের খাচার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। কে জানে মনে মনে হয়তো ভাবেন–বানর থেকে মানুষে বিবর্তন হওয়ার প্রয়োজনটা কি ছিল! বানর হয়ে গাছে গাছে জীবনটা পার করে দিতে পারলে জীবনটা কত সুখময় হত!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষকের ছিল। ছাগলপ্রীতি। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারেই ছাগল পুষতেন। একটা-দুটা না–গোটা সাতেক। রাতে ঘুমুতেন ছাগলের সঙ্গে। অবিশ্বাস্য এই ঘটনা শুনে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন–এগুলি ছাগল না, পাঠা। আমার একটা অসুখ আছে। পাঠার গায়ের গন্ধে সেই অসুখ সারে বলে আমি রাতে তাদের সঙ্গে। ঘুমাই।
আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমি কি করি না করি তা আমার ব্যাপার। ব্যক্তি-স্বাধীনতা আমার সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের… ধারার উপধারায়…।
আমি বললাম, তা তো বটেই। আপনি অবশ্যই পাঁঠাদের সঙ্গে ঘুমুতে পারেন।
প্রিয় পাঠক, আমি এই গল্প রসিকতার জন্যে ফাঁদিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় খোঁজ নিলেই ঘটনার সত্যতা জানতে পারবেন।
পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই–এমন কোন পশু কি আছে যা গোটা মানব সম্প্রদায়ের প্রিয়? বা বড় একটি মানবগোষ্ঠীর প্রিয়? আমার ধারণা আছে–সেই পশুর নাম হাতি, যাকে দেখামাত্র একসঙ্গে বিস্ময়, ভয় এবং করুণায় মন কেমন কেমন করে ওঠে। বিস্ময় এবং ভয়ের কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। করুণ কেন হয়। বলি। করুণা হয়–বিশাল একটা প্রাণী মানুষের মত ক্ষুদ্র প্রাণীর হাতের পুতুল হয়ে ঘুরছে, এই কারণে। একটা পিপড়া ছাগলের গলায় দড়ি বেঁধে তাকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে–এই দৃশ্যে যে করুণ রস আছে, হাতি এবং মানুষের ব্যাপারে তেমন করুণ রস আছে।
আমাদের বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাতি খুবই পরিচিত প্রাণী। এইত সেদিন ঢাকা শহরে এক বিয়েতে দেখলাম হাতিতে চেপে বর যাচ্ছে। বেচারার উচিত এক হাতে। রুমাল নিয়ে রুমালে মুখ চেপে ধরে রাখা। সে তা করছে না। ভয়ে অস্থির হয়ে দুহাত দিয়ে জাপটে সামনের মানুষটির কোমর ধরে আছে।
ছোটবেলায় খুব কাছ থেকে হাতি দেখার সৌভাগ্য হল নানার বাড়িতে। আমার এক দূর-সম্পকের নানা চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। তার মার্কা হল হাতি। তিনি নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে এক হাতি নিয়ে এলেন। হাতির পিঠে চড়ে তিনি প্রচার-অভিযানে বের হন–গ্রামের অর্ধেক মানুষ সেই হাতির পেছনে পেছনে যায়। আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে ভোট দিবেন কিসে? হাতী মার্কা বাক্সে। শুধুমাত্র হাতির কল্যাণে আমার সেই দূর-সম্পর্কের নানা ইলেকশনে পাশ করে ফেলেন। সেই ইলেকশনের হাতিতে আমি অনেকবার চড়েছি। হাতির পিঠে চড়া সম্পর্কে যা যা জেনেছি তা হচ্ছে–
হাতির পিঠে চড়া এবং নৌকায় চড় এক রকম। দুটোতেই দুলুনি আছে। একই রকম দুলুনি।
নাক ভর্তি সর্দি না থাকলে হাতির পিঠে চড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাতির গায়ে একশ হর্স পাওয়ারের বিকট গন্ধ।
হাতির গায়ের লোম সাধারণ লোমের মতো না–সুইয়ের মত শক্ত। লোমের পেছনে ফুটো থাকলে অনায়াসে গ্রামের মেয়েরা হাতির লোম দিয়ে কথা সেলাই করতে পারত।
শৈশবে বেশ কিছুদিন হাতির কাছাকাছি থাকার কারণে আমার ধারণা হয়েছিল–হাতি সম্পর্কে আমি একজন নলেজেবল ব্যক্তি। এই বিরাট পশু সম্পর্কে যা জানার সবই জেনে ফেলেছি। আরো যে অনেক কিছু জানার বাকি তা টের পেলাম এই সেদিন। ঘটনাটা বলি–ঈদের আনন্দমেলা অনুষ্ঠান। আমার উপর দায়িত্ব একটা ছোট্ট তিন-চার মিনিটের হাসির অংশ তৈরি করা। আমি হাতি দিয়ে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলাম। হাতির পিঠে চড়ে অয়োময়ের ছোট মীর্জা এবং তার লাঠিয়াল হানিফ এসেছে গাউছিয়ায় ঈদের বাজার করতে।