উৎসব শব্দটা মাথায় এলেই যে ছবি আমার চোখে ভাসে সে ছবি হৈচৈ-এর ছবি। ভেঁপু বাজানোর ছবি, নাগরদোলার ছবি। ঢাকা শহরের নাগরিক রমনা বটমূলকেন্দ্রিক পহেলা বৈশাখের উৎসব মোটেই সেরকম না। বলা যেতে পারে সিরিয়াস টাইপের উৎসব, যার নিয়মকানুন বেশ কড়া। রিচুয়েলের দিক থেকে বিচার করলে এই উৎসব খানিকটা ধর্ম উৎসবের মত। সূর্য ওঠার আগেই উপস্থিত হতে হয়। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা গান ধরেন–এসো হৈ বৈশাখ। উদ্বোধনী এই গানের পর একের পর এক রবীন্দ্র সংগীত চলতে থাকে। অন্য কোন গান নয়। শ্রোতাদের গম্ভীর ভাব করে গান শুনতে হয়। কারো ভেতর সামান্যতম তারল্য ভাব দেখা গেলে আশেপাশের সবাই কঠিন চোখে তাকায়। যে দৃষ্টির অর্থ–এই অসংস্কৃত গাধা কোত্থেকে এসেছে? প্রচণ্ড ভিড়ে ঠেলাঠেলি করতে করতে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে ভাল লাগে না।
গানপর্ব শেষ হবার পরের অংশটা অবশ্যি বেশ মজার। নগরবাসী আধুনিক বঙ্গসন্তানরা তখন খাঁটি দেশীয় খাবারের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উৎসব উপলক্ষে গজিয়ে ওঠা খাবারের দোকানের সামনে ভিড় করেন। শানকিতে পান্তাভাত, পোড়া মরিচ দেয়া হয়। নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে সেই প্রচণ্ড ঝাল পান্তাভাত খেতে খেতে এক একজন ঘোর লাগা গলায় বলেন, আহা রে, কি অপূর্ব খাবার। ধন্য জন্মেছি এই দেশে!
আমার লেখা থেকে মনে হতে পারে, আমি বোধহয় বটমূলের নববর্ষ আবাহনী উৎসবকে তুচ্ছ করার চেষ্টা করছি। একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে সস্তা রসিকতা করার চেষ্টা করছি। তা কিন্তু নয়। এই উৎসব এখন আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসবের একটি। একে তুচ্ছ করার কোন উপায় নেই। কেন, তা একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
এই বাংলায় পহেলা বৈশাখ কখনোই আনন্দময় উৎসবের কোন দিন ছিল না। জমিদাররা এই দিনে পুণ্যাহ করতেন। সেই পুণ্যাহ জমিদারের খাজনা আদায়ের উৎসব। প্রজাদের জন্য সুখকর কিছু না। ব্যবসায়ীরা করতেন হালখাতা। সেখানেও সাধারণদের ভূমিকা হল বকেয়া টাকাপয়সা দেয়া। নতুন বৎসর তাদের কাছে আনন্দ নিয়ে আসে না। আসে আশংকা নিয়ে–না জানি কেমন যাবে সামনের দিন! তাছাড়া কিছুদিন আগেই হয়ে গেছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। আর কেন? বৈশাখ মাস উৎসবের জন্য আদর্শ নয়। আছে কালবোশেখী, শিলাবৃষ্টি। এই মাসে কৃষকদের কাজের চাপও প্রচণ্ড। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই, উৎসব তো অনেক পরের ব্যাপার।
এদেশে বাংলা নববর্ষ পালনের ধারণাটা পশ্চিম থেকে পাওয়া। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকরা নওরোজ করতেন। তবে তার প্রভাবে এদেশে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়নি। রাজা-বাদশাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এদেশের মানুষ কিছু করে না। বর্ষপালন প্রক্রিয়া। শুরু করলেন আধুনিক কিছু মানুষ, তাও বিচ্ছিন্নভাবে ঘরোয়া ভঙ্গিতে। পঞ্চাশ দশকের দিকে কবি বেগম সুফিয়া কামালের তারাবাগের বাসভবনে পহেলা বৈশাখ পালিত হত। কবি জাহানারা আরজুর বাসভবন কবিতাঙ্গনে বাংলা নববর্ষ বেশ ঘটা করে করা হত।
ভাষা আন্দোলনের পর পর আমাদের চিন্তা-ভাবনায় কিছু পরিবর্তন দেখা দিল। প্রয়োজন হয়ে পড়ল স্বকীয়তা অনুসন্ধানের। আমরা বাঙালীরা আলাদা, এটা যেমন নিজেদের জানার দরকার হয়ে পড়ল, অন্যদেরও জানানোর প্রয়েজনীয়তা দেখা দিল। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার পায়তারাও তখন চলছে, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবেও প্রয়োজন হল রবীন্দ্র সংগীতের। ১৯৬৭ সনে প্রথম এগিয়ে এল ছায়ানট, রমনা বটমূলে রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে আবাহন করা হবে বাংলার নতুন। বছরকে। এই আবাহন বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছুই নয়। যোগ দিলে হাজারো মানুষ। যে নাগরিক উৎসবের পেছনের ইতিহাস এত গৌরবের তাকে ছোট করে দেখা নিজেকেই ছোট করে দেখা।
যতই দিন যাচ্ছে এই উৎসবের ব্যাপকতা ততই বাড়ছে। স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিলেন। উৎসবপালনে এগিয়ে এল অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উৎসব। বাংলা একাডেমীতে লোক উৎসব, শিশু একাডেমীর মেলা, বিসিকের মেলা, পুরানো ঢাকার ধূপখোলা মাঠে তিনদিন ধরে বৈশাখী মেলা। দুতিন বছর হল এই দিনে আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা বর্ণাঢ্য র্যালী বের করা শুরু করেছেন। সে এক দেখার মত দৃশ্য। বিচিত্র। সব মুখোশ, রংচংয়ে পোশাক, বাদ্য-বাজনা–সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার। মিছিল যখন বের হয় তখন ইচ্ছা করে মজাদার একটা মুখোশ পরে আমিও ওদের মত নাচানাচি করি। নানান কারণে তা করা হয় না। মুখ শুকনো করে বলতে হয়, আচ্ছা, এরা শুরু করেছে কি?
গত বছর নববর্ষের আগের দিনটিতে আমি ছিলাম কোলকাতায়। বাংলাদেশ মিশনের আয়েজিত-গ্রন্থমেলার অতিথি। ভাবলাম, এসেছি যখন কোলকাতার পহেলা বৈশাখের উৎসবটা দেখেই যাই, তাছাড়া, তখন ১৪০০ সাল পূর্তি উপলক্ষে অনেক কিছু হচ্ছে। বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে কথা বলে আরো দুদিন থাকার ব্যবস্থা হল। তারপরেই মনে হল, আরে কি করছি? বাংলা নতুন বছরে আমি রমনা বটমূলের আশেপাশে থাকব না, তা কি করে হয়? সূর্য ওঠার আগে অবশ্যই উঠতে হবে। গান শুনতে হবে, মাটির শানকিতে করে পান্তাভাত খেতে হবে পোড়া মরিচ মাখিয়ে। একদিনের বাঙালী বলে অনেকেই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, করুক। আমি আগুন ঝাল পান্তা খেতে খেতে, বৈশাখের কড়া রোদে পুড়তে পুড়তে বলব, ধন্য! জন্মেছি এই দেশে।
পোট্রেট
অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের বাসায় আমি মাঝে মাঝে যাই। তাঁর স্ত্রী খুব ভাল বেগুনভাজা রান্না করেন। বেগুনভাজার লোভে যাই বললে ভুল বলা হবে। খাদ্য হিসেবে বেগুন আমার তেমন প্রিয় নয়। তবে এই দম্পতির সঙ্গ প্রিয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিতান্ত ভালমানুষ। আমার যে-কোন রসিকতায় এঁরা হো হো করে হাসেন। তাদের বাড়িটা ছোটখাটো একটা মিউজিয়ামের মত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ধরনের শিল্পকর্ম। দেয়ালে ঝুলছে অপূর্ব সব পেইনটিং। কিছু কিছু অতি বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা। ছবিগুলোও আমার বাড়তি আকর্ষণ। পেইন্টিং পুরোনো হয় না। একই ছবি বারবার দেখা যায়। আমি মাঝে মাঝে ছবি দেখার লোভেও যাই।