আমি বিনীতভাবে বললাম, কেউ তো নিতে আসেনি।
আমার এত লোকজন কোথায় যে পাঠাব! আপনি নিজে এসে দিয়ে যেতে পারেন।? আপনিতো এলিফেন্ট রোডেই থাকেন। দুমিনিটের পথ।
আমি আসছি। ভাল কথা আপনার সঙ্গে রাগারাগি করার মত একটা ঘটনা। ঘটেছে। আমি এসেই কিন্তু রাগারাগি করব।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
এসে নেই তারপর বুঝবেন।
না এখনই বলুন।
আমার বড় মেয়ে নোভার ছিল মাথা ভর্তি চুল। আপনি হচ্ছেন তার আদর্শ। আপনার মাথার ছোট ছোট চুল তার খুব পছন্দ। সে আপনার মত হবার প্রথম ধাপ। হিসেবে তার মাথার সব চুল কেটে ফেলেছে।
সত্যি?
বাসায় আসুন। বাসায় এসে দেখে যান।
একেবারে কিশোরী গলায় তিনি অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, আপনার মেয়েকে বলবেন লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়। আমি যখন ওর বয়েসী ছিলাম তখন আমার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল ছিল। ছবি আছে। আমি আপনার মেয়েকে ছবি দেখাব। চুল কেটে ছোট করতে হয়েছে ক্যান্সারের জন্যে। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়ে যাচ্ছিল। কি আর করব?
তিনি একবার আমার বাসায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমার মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। তাঁর গল্প করতে ইচ্ছা করছে। গাড়ি পাঠিয়ে তাকে আনালাম। বাসায় আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। গ্রহ যেমন সূর্যকে ঘিরে রাখে আমার মেয়েরাও তাকে সেই ভাবে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়ল। তিনি তাদের বললেন তার। শৈশবের কথা। আমি আসরে যোগ দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, আপনি আসবেন না। এই আসরে আপনার প্রবেশাধিকার নেই।
অন্যান্য ফ্ল্যাটে খবর চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা আসছে। তারাও গল্প শুনতে চায়।
আমার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অতি সম্মানিত এই মানুষটিকে সে কি খাওয়াবে? তিনি তো কিছুই খেতে পারেন না।
তিনি আমার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন, শুধু মুখে যাবেন না। কিছু খাবেন। পাকা পেঁপে থাকলে ভাল হয়।
ঘরে পাকা পেঁপে নেই। আমি ছুটলাম পাকা পেঁপের সন্ধানে। লিফট থেকে নামতেই এক ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে বললেন, জানেন, আমাদের এই ফ্ল্যাটের কোন এক বাড়িতে জাহানারা ইমাম এসেছেন।
আনন্দে আমার মন দ্রবীভূত হল। এই মহীয়সী নারী কত অল্প সময়ে মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছেন।
তাঁর মৃত্যু সংবাদ আমাকে দেন আসাদুজ্জামান নূর।
বাসায় তখন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে। আমার মেয়েরা জন ডেনভারের গান শুনছে রকি মাউন্টেন হাই, কলারাডো। সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, আন্দোলন এখন কে এগিয়ে নিয়ে যাবে? আমি তাকে বললাম, দ্বিতীয় জাহানারা ইমাম আমাদের নেই। জাহানারা ইমাম দুটা তিনটা করে জন্মায় না। একটাই জন্মায়। তবে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেই। অপেক্ষা করুন।
মা জায়নামাজে বসলেন।
আর আমি একা একা বসে রইলাম বারান্দায়। এক ধরনের শূন্যতা বোধ আমার ভেতর জমা হতে থাকল। কেবলি মনে হতে লাগল একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। কি পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এই মানুষটির প্রতি আমার ছিল তা তাকে জানানো হয়নি। আমার একটাই সান্ত্বনা মৃত্যুর ওপাশের জগৎ থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অনুভব করতে পারছেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি সবসময়ই তার পাশে ছিলাম। যে কদিন বেঁচে থাকব তাই থাকব। বঙ্গজননীর পাশে তার। সন্তানরা থাকবে না তা কি কখনো হয়?
বাংলার পবিত্র মাটিতে তাঁর পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের এই সংবাদে উল্লসিত হবার কিছু নেই। বাংলার হৃদয়ে তিনি জেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড় ঝাপ্টা যত প্রচণ্ডই হোক না কেন সেই শিখা জ্বলতে থাকবে। কি সৌভাগ্য। আমাদের তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে।
ধন্য! জন্মেছি এই দেশে
আমার বড় মেয়ে পড়ে হলিক্রস কলেজে। একেকটা কলেজের মেয়েরা একেক ধরনের হয়। হলিক্রস কলেজের মেয়েদের ভেতর ইংরেজি ভাবটা খুব প্রবল। কাজেই আমার বড় মেয়ে যখন আমাকে এসে বলল, তার ইচ্ছা বাসায় একটা স্লাম্বার পার্টি দেয়, তখন আমি তেমন বিস্মিত হলাম না। শুধু ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, স্লাম্বার পার্টি ব্যাপারটা কি? জানা গেল, স্লাম্বার পার্টি হচ্ছে কিছু বান্ধবী একত্র হয়ে হৈ-চৈ করবে এবং রাতে এক বিছানায় ঘুমুবে। আমি অতিরিক্ত রকমের উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, স্লাম্বার পাটি খুব প্রয়েজনীয় একটা ব্যাপার। নিশ্চয়ই এতে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। তুমি এই পার্টি করতে চাচ্ছ শুনে ভাল লাগল। তা এই পার্টিটা কবে হচ্ছে?
আমার কন্যা বেণী দুলিয়ে বলল, পার্টি হবে নিউ ইয়ার্স ইভে। সারারাত আমরা ঘুমুব না।
নিউ ইয়ার্স ইভ বললে আমরা ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ বুঝে থাকি। এখন এপ্রিল মাস, এক বছর আগে দিনক্ষণ ঠিক হচ্ছে কেন বুঝতে পারলাম না। জানা গেল, এই নিউ ইয়ার্স ডে হল বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ। আমার কন্যা তার বান্ধবীদের নিয়ে। বাংলা নববর্ষ বরণ করবে। পায়ে আলতা পরবে, চুলে গুজবে সাদা রং-এর ফুল। কন্যার এক বান্ধবী সম্প্রতি চুল কেটে পাংকু হয়েছে। বাংলা নববর্ষের উৎসবে তো আর। পাংকু সেজে যাওয়া যায় না, কাজেই সে সিঙ্গাপুর থেকে নকল চুল আনিয়েছে। সেই চুল হাঁটু পর্যন্ত নেমে যায়। খাঁটি বঙ্গললনা হবার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। আমার পবিত্র দায়িত্ব হল, এদের সবাইকে সূর্য ওঠার আগে রমনা বটমূলে নিয়ে যেতে হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা হল। সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে ওঠা আমার কাছে এক ধরনের ক্রাইম বলে মনে হয়। ঠিক সময়ে ওঠা সূর্যের জন্য খুব জরুরী, আমার জন্যে নয়। তার চেয়েও বড় কথা, পহেলা বৈশাখের যে নাগরিক উৎসব ঢাকায় চালু হয়েছে তা আমাকে আগের মত আর আকর্ষণ করে না।