আমাদের নিজেদের অবস্থাও তখন শোচনীয়। দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। মেয়েটি প্রায়ই আসে। শেষের দিকে আর টাকা চাইতে আসতো না। ছোট্ট একটা বাটি নিয়ে রাত করে আসতো। মাটির দিকে তাকিয়ে বলতো, খালাম্মা, বাটিটাতে একটু ভাত আর ডাল দিন আমার মেয়ে দুটির জন্যে।
এক সকালবেলা বাড়িওয়ালা তাদের বের করে দিল। আমি সকালবেলা বারান্দায় দাঁত মাজতে এসে দেখি, স্বামী-স্ত্রী তাদের পুরোনো বাসার গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জিনিসপত্র চারদিকে ছড়ানো। বাচ্চা দুটি খুব কাঁদছে।
পৃথিবী নামক এই গ্রহের সবচে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। কি প্রচণ্ড তার ক্ষমতা! একদিন সে জয় করবে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, কিন্তু আজ তার একি পরাজয়!
তিনি
রাত নটার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।
আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায় চকচক করছে। ব্যাপারটা ঠিক। বুঝলাম না। বিখ্যাত মানুষরা যে আমাকে একেবারেই টেলিফোন করেন না তাতো না। মেয়ে এত উত্তেজিত কেন?
বাবা তুমি কিন্তু আবার বলতে বলবে না যে তুমি বাসায় নেই। তোমার বিশ্রী। অভ্যাস আছে বাসায় থেকেও বল বাসায় নেই।
আমি বললাম, টেলিফোন কে করেছে মা?
আমার মেয়ে ফিসফিস করে বলল, জাহানারা ইমাম।
এই নাম ফিসফিস করে বলছ কেন? ফিসফিস করার কি হল?
বাবা উনি যখন বললেন, তার নাম জাহানারা ইমাম তখন আমি এতই নার্ভাস হয়ে গেছি যে, তাকে স্নামালিকুম বলতে ভুলে গেছি।
বিরাট ভুল হয়েছে। যাই হোক দেখা যাক কি করা যায়।
আমি টেলিফোন ধরলাম এবং বললাম, আমার মেয়ে আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছে এই জন্যে সে খুব লজ্জিত। আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
ওপাশ থেকে তার হাসির শব্দ শুনলাম। হাসতে হাসতেই বললেন, আমি কিন্তু আপনাকে টেলিফোন করেছি কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে।
বলুন।
আপনি রাগ করুন বা না করুন কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে।
আমি শংকিত হয়ে আপনার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
আপনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পত্রিকায় লেখেন কেন? আপনার মত আরো অনেকেই এই কাজটি করে। কিন্তু আপনি কেন করবেন?
তিনি কথা বলছেন নিচু গলায়, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কোন অস্পষ্টতা নেই। কোন আড়ষ্টতা নেই।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। আক্রমণ এইদিক থেকে আসবে ভাবিনি। তবে পত্রিকায়। লেখা দেয়ার ব্যাপারে আমার কিছু যুক্তি আছে। খুব যে দুর্বল যুক্তি তাও না। যুক্তিগুলো তাকে শোনালাম। মনে হল এতে তিনি আরো রেগে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন, আপনার মিসির আলী বিষয়ক রচনা আমি কিছু কিছু পড়েছি, আপনি যুক্তি ভাল। দেবেন তা জানি। কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে যুক্তি শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে ওদের পত্রিকায় লিখে ওদের হাত শক্তিশালী করবেন না। আপনি একজন শহীদ পিতার পুত্র। তুই রাজাকার শ্লোগান আপনার কলম থেকে বের হয়েছে। বলুন আর লিখবেন না।
আমি সহজে প্রভাবিত হই না। সে রাতে হলাম। বলতে বাধ্য হলাম, আপনাকে কথা দিচ্ছি আর লিখব না। এখন বলুন আপনার রাগ কি কমেছে? তিনি হেসে ফেললেন। বাচ্চা মেয়েদের একধরনের হাসি আছে–কুটকুট হাসি, বড়দের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে যে হাসিটা তারা হাসে সেই হাসি।
আমি বললাম, আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলেন। নিজেকে খুব দূরের মানুষ মনে হয়। দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবেন। তিনি বললেন, আচ্ছা বলব। এখন থেকে বলব।
তিনি কিন্তু আমাকে তুমি কখনই বলেননি। যতবারই মনে করিয়ে দিয়েছি। ততবারই বলেছেন, হ্যাঁ এখন থেকে বলব। কিন্তু বলার সময় বলেছেন আপনি। হয়তো আমাকে তিনি কখনোই কাছের মানুষ মনে করেননি।
তার অনেক কাছের মানুষ ছিল আমার মা। আমার ছোট ভাই জাফর ইকবাল। জাফর ইকবালের উল্লেখ তার লেখাতে পাই। ব্যক্তিগত আলাপেও জাফর ইকবালের প্রসঙ্গে তাকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখি। শুধু আমার ব্যাপারেই এক ধরনের শীতলতা। হয়তো তার ধারণা হয়েছিল, যে মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন আমি সেই আন্দোলন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি। যে ১০১ জনকে নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আদি যাত্রা, আমি সেই ১০১ জনের একজন। অথচ পরে আমার আর কোন খোঁজ নেই। কাজেই আমার ভূমিকায় অস্পষ্টতাতো আছেই। তিনি আমার প্রতি শীতল ভাব পোষণ করতেই পারেন। সেটাই স্বাভাবিক।
আরেক দিনের কথা, তিনি টেলিফোন করেছেন। গলার স্বর অস্পষ্ট। কথা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, আপনার শরীর কি খারাপ করেছে?
তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীর আছে শরীরের মতই। আপনাকে একটা ব্যাপারে টেলিফোন করেছি।
বলুন কি ব্যাপার।
এই যে একটা আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এতে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আমাকে চলতে হচ্ছে মানুষের চাদায়। আপনি প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দেবেন।
অবশ্যই দেব।
আমি একজনকে পাঠাচ্ছি। এ মাসের চাঁদা দিয়ে দিন।
জি আচ্ছা, কত করে দেব?
আপনি আপনার সামর্থ্য মত দেবেন। মাসে দুহাজার করে দিতে পারবেন?
পারব।
একজন এসে চাঁদা নিয়ে গেল। পরের দুমাস কেউ চাঁদা নিতে এলো না। আমার একটু মন খারাপ হল। মনে হল হয়ত সিদ্ধান্ত হয়েছে আমার কাছ থেকে চাঁদা নেয়া। হবে না। তৃতীয় মাসে তিনি টেলিফোন করে বললেন, কি ব্যাপার, আপনি আপনার চাদার টাকা দিচ্ছেন না কেন?