চল্লিশ বছর আগে আমার মার খালু এমনই এক মেহমানী উৎসবে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিলেন। অতিথিদের খেতে বলার পর তিনি হঠাৎ কঁদতে শুরু করেছিলেন। সেদিন মনে হয়েছিল, তিনি মেকি কান্না কাঁদছেন। চল্লিশ বছর পর চোখের জল ফেলতে ফেলতে বুঝলাম, তার সেদিনের কান্না মেকি ছিল না। আমি তাঁর আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম।
আমার মনে হল–যদি আমার ক্ষমতা থাকতো, আমি অবশ্যই এদেশের প্রতিটি নিরন্ন মানুষকে খাওয়াতাম। আমি জানি, আমার এই আবেগ সাময়িক–আমি শহরে ফিরে যাব, আমার আর কিছুই মনে থাকবে না। তবুও ক্ষণিকের জন্যে হলেও এক মহান বোধ আমার ভেতর সৃষ্টি হয়েছিল–তার মূল্যই বা কম কি? যে মঙ্গলময় আমার ভেতর এই বোধ তৈরি করেছিলেন–তিনি সেই বোধ সবার ভেতর ছড়িয়ে দিবেন–এই আমার প্রার্থনা।
আঙুল
আগুনের পরশমণি ছবি করার সময়কার কথা–একটা দৃশ্য আছে মিলিটারী একজন মুক্তিযোদ্ধার আঙুল কেটে ফেলে। আমি ভাবলাম–এমন একজন কাউকে যদি পাওয়া যেত যার হাতের দুটি আঙুল কাটা পড়েছে তাহলে খুব ভাল হত। সরাসরি তার হান্টা ক্যামেরায় দেখানো যেত।
ফিল্ম লাইনের প্রডাকশানে সাইডে যারা কাজ করেন তারা পারেন না হেন ব্যাপার নেই। আমি আঙুল কাটা পড়েছে এমন একজনকে খুঁজছি শুনে তারা বললেন, স্যার, আপনি নিশ্চিত থাকুন। এক সপ্তাহের ভেতর আপনি লোক পাবেন।
ওদের কথা আমি বিশ্বাস করিনি। দৃশ্যটা অন্যভাবে লেখার পরিকল্পনা করে ফেললাম। তখন সত্যি সত্যি লেদ মেশিনে আঙুল করার কাঁটা পড়েছে এমন একজন তারা উপস্থিত করল। লোকটিকে আমি ব্যবহার করিনি তবে তার কাটা আঙুলগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথার ভেতর একটা গল্প তৈরি হয়ে গেল। গল্পটি দেশের কোন পত্রিকায় ছাপা হয়নি–কোলকাতার একটি শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে গল্পটি দিয়ে দিচ্ছি। গল্প কিভাবে তৈরি হয় অনেকে জানতে চান। গল্প তৈরির অনেক প্রক্রিয়ার একটি বলা হল—
দেখি হাত দেখি।
এক হাত মেললেই হয়–মোবারক দুহাত মেলে ধরল। মোবারকের কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে ডাক্তারকে হাত দেখাচ্ছে। বামুনদের মত বেঁটে যে ভদ্রলোক হাত দেখছেন–তিনি কোন ডাক্তার না। ফিল্মের ডাইরেক্টার। ফিল্মের নাম শেষ প্রতিশোধ।
মোবারক লক্ষ্য করল উত্তেজনায় তার হাতের আঙুল কাঁপছে। দশটা আঙুল কাপার কথা, তার কাঁপছে সাতটা। কারণ ডান হাতের পাঁচটা আঙুলের মধ্যে তিনটা তার নেই, লেদ মেশিনে কাটা পড়েছে। মেশিনে কাটা বলেই সুন্দর করে কাটা। দেখতে খুব খারাপ লাগে না।
ডাইরেক্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে কাটা আঙুল দেখছেন। তার পছন্দ হচ্ছে কিনা। মোবারক বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোকের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বেঁটে লোক খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়।
আপনার নাম কি বললেন যেন?
স্যার, আমার নাম মোবারক।
আমরা আসলে চেয়েছিলাম চারটা আঙুল কেটেছে এমন লোক। এক হাতে শুধু একটাই আঙুলের অন্য এক ধরনের বিউটি আছে। যাই হোক, আপনাকে দিয়েও চলবে। অভিনয় করেছেন কখনো?
জ্বি না স্যার।
অভিনয় না করলেই ভাল। যা বলব ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তাই করবেন। পারবেন না?
জ্বি স্যার পারব।
গুড। খুব সহজ দৃশ্য। এক অত্যাচারী লোক তোমাকে ধরেছে। সে ছড়তা দিয়ে কচ কচ করে তোমার হাতের তিনটা আঙুল কেটে ফেলবে। এক একবার কাটবে আর তুমি আঁ বলে এক চিৎকার দিবে।
মোবারকের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ডাইরেক্টার সাহেব একটু আগে তাকে আপনি করে বলছিলেন, এখন তুমি বলছেন। শুরু থেকে তুমি করে বললে অস্বস্তি লাগত না। প্রথম কিছুক্ষণ আপনি বলায় লাগছে। ছড়তা দিয়ে আঙুল কাটার ব্যাপারটাও সে বুঝতে পারছে না। আঙুল তো কাটাই আছে, আবার নতুন করে কাটবে কি?
তোমার বুকে লোম আছে?
মোবারক লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি না স্যার।
ডাইরেক্টার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, পুরুষের বুকে লোম আজকাল উঠেই গেছে। কারণটা বুঝলাম না। যাই হোক, তুমি শার্টটা খুলে ফেল। খালি গায়েই ভাল। লাগবে। খোল, শার্ট খোলা ছিল।
এত লোকের মাঝখানে শার্ট খুলতে মোবারকের লজ্জা লাগছে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন পুরুষ মানুষের উদোম হওয়ার দৃশ্য তারা আগে দেখেনি। এদের মধ্যে মেয়েছেলেও আছে। একটা মেয়ে তো একেবারে লাল টুকটুক, গদি দেয়া চেয়ারে। বসে আছে। নায়িকা-টায়িকা হবে। নায়িকা না হলেও নায়িকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কিংবা ছোট বোন। মেয়েটা একটু পরপর বিশ্রী ভঙ্গিতে হাই তুলছে। তার মুখটা ছোট তবে হা। করার সময় বিশাল হয়ে যাচ্ছে, জিভ দেখা যাচ্ছে। কালো রঙের একটা জিভ। মোবারকের মনে হল, মেয়েটার জিভটা রঙ করে দেবার দরকার ছিল। লাল টুকটুক চেহারার সঙ্গে কাল জিভ মিশ খাচ্ছে না।
ডাইরেক্টার সাহেব বললেন, তোমার নাম যেন কি বললে?
স্যার মোবারক।
শোন মোবারক, তুমি চুপ করে বসে থাক। তোমার শট কখন নেব বুঝতে পারছি। প্রডাকশনের কেউ আছে? মোবারককে চ-বিসকুট দে।
মোবারক লজ্জিত মুখে বসে আছে। সামান্য কয়টা টাকার জন্যে এই ঝামেলায়। আসাটা ঠিক হয়েছে কি না, বুঝতে পারছে না। মোবারক শুধু যে নিজে লজ্জা পাচ্ছে তা না, তার ধারণা তার ডান হাতটাও লজ্জার মধ্যে পড়েছে। আগে যেখানে আঙুল ছিল। সেই জায়গা চুলকাচ্ছে। আঙুল নেই অথচ চুলকাচ্ছে–যাকে বলে ভৌতিক অবস্থা। এরকম তার মাঝে মাঝে হয়। লজ্জা বা অস্বস্তির মধ্যে পড়লে বেশি হয়। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না বলে মোবারক ব্যাপারটা কাউকে বলেনি, শুধু লতিফাকে বলেছে।