ছুনু বলল, বেয়াদবী না নিলে একটা সিগারেট দেন স্যার। খাইয়া দেখি। বিড়ি টানতে টানতে কইলজার কাম শেষ।
আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করলাম। গনি সাহেব হা হা করে উঠলেন, হাতে দিবেন না স্যার। হাতে দিবেন না। মাটিতে ফিক্যা মারেন, বলে তিনি অপেক্ষা করলেন না। আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিজেই ছুনুর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। ছুনু সেই সিগারেট শূন্য থেকে লুফে নিল।
গনি সাহেব বললেন, এই হারামজাদার কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। হারামজাদার চোখ শয়তানের চোখের চেয়েও খারাপ।
আমি বললাম, কি রকম খারাপ?
গনি সাহেব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ধরেন একটা লকলকা লাউ গাছ, ছুনু যদি সেই গাছ দেখে বলে, আহা কি সুন্দর, তা হইলেই কাম সারা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গাছের মৃত্যু।
ছুনু আপত্তির গলায় বলল, কিছু না বললেও হয়, বলা লাগে না।
আমি সন্দেহের গলায় বললাম, এটা কি পরীক্ষিত?
আমার সন্দেহে গনি সাহেব আহত হলেন। ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, অবশ্যই পরীক্ষিত। গাছপালা, গরু-ছাগল, মানুষ সবেতেই তার চোখ লাগে।।
ছুনু উদাস গলায় বলল, কলকব্জার মধ্যেও লাগে। গনি চাচা, বজলু ভাইয়ের। সাইকেলের গফটা স্যাররে বলেন। স্যার মজা পাইব।
বজলুর সাইকেলের গল্প শুনলাম। বজলু স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, নতুন সাইকেল কিনেছে। প্রিন্স সাইকেল। অনেকের সঙ্গে ছুনুও সাইকেল দেখতে গেল এবং ফস করে মনের ভুলে বলে বসল, জবর সাইকেল খরিদ করছেন বজলু ভাই। এমুন। সাইকেল লাখে এক।
এই বলাই কাল হল। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের চাকা বাল্ট। শব্দ। হয়েছিল দুনলা বন্দুকের গুলির মত।
গল্প শুনে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করব কি না বুঝতে পারছি না। আমি বিস্মিত হলে গনি সাহেব খুশি হন। তিনি গত তিনদিন ধরে আমাকে নানানভাবে বিস্মিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গতকাল এক গায়ক নিয়ে এসেছিলেন, যার গলা নাকি অবিকল হেমন্তের মত–কোন উনিশ-বিশ নেই। গায়কের গলা আসলেই ভাল। তবু গণ্ডগ্রামের লুঙ্গি পরা খালি গায়ের গায়কের গলায় তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বিস্তি এল শুনতে ভাল লাগে না। ঝাড়া দুঘণ্টা হেমন্তের গান শুনলাম। গায়কের ধৈর্য যেমন অসীম, মুখস্থ গানের সংখ্যাও অসীম। গান শুনে আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত। তারপরেও বিস্মিত, অভিভূত হবার ভঙ্গি করে বলতে হল, অদ্ভুত। এরকম শুনিনি। গনি সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বড়ই আফসোস! কত বড় বড় প্রতিভা পল্লীগ্রামে নষ্ট হইতেছে।
কে জানে ছুনু মিয়াও হয়তো এদের চোখে বিরাট প্রতিভা। পল্লীগ্রামে অনাদরে নষ্ট হচ্ছে। আমাকে দেখিয়ে সেই প্রতিভার খানিক স্বীকৃতিও যদি পাওয়া যায়। গনি সাহেব আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললেন, ভাই সাহেব, ছনুর চোখ বড়ই ডেঞ্জারাস। ভেরী ভেরী ডেঞ্জারাস।
গ্রামের মানুষদের এই আরেক অভ্যাস, কানে কথা বলা। ছুনুর চোখ ডেঞ্জারাস এই তথ্য আমার কানের ভেতরে দিয়ে দেয়ার দরকার নেই। এটা তেমন গোপন তথ্যও না। এমন না যে ছুনু এই গোপন সংবাদ দিয়ে দেয়ায় আহত হবে। ছুনু এই খবরে খুশি হয়। বলেই আমার ধারণা। সে যে একজন ডেঞ্জারাস ব্যক্তি তা প্রমাণ করার জন্যে ছুনুর নিজের ব্যস্ততাও কম না। গনি সাহেবের চেয়ে বেশি বলেই তো মনে হচ্ছে।
ছুনু বলল, বিয়া বাড়ির গফটা করেন, স্যার মজা পাইব। বড়ই মজার গফ।
মজা পাবার জন্যে আমি তেমন অস্থির ছিলাম না। তারপরেও বিয়ে বাড়ির গল্প শুনতে হল। তিন বছর আগের ঘটনা। এই গ্রামেরই এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। বর। আসছে পাল্কিতে। পথে ছুনুর সঙ্গে দেখা। ছুনু পাল্কি দেখে মুগ্ধ হয়ে (মনের ভুলে) বলে ফেলল, মেলা দিন পরে পাল্কি দেখলাম। বড়ই সৌন্দর্য! ছুনুর কথা শেষ হবার আগেই পাল্কি ভেঙে ধান ক্ষেতে পড়ে গেল। সেখানে আবার এক হাঁটু পানি। নতুন বর কাদায় পানিতে মাখামাখি। কনেবাড়ির লোকজন খবর শুনে ছুনুকে ধরে ইচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে। নীলগঞ্জ সদর হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল চারদিন।
ছুনু হাসিমুখে বলল, আরেকটু হইলে জানে মাইরা ফেলত স্যার। অল্পের জন্যে জেবন রক্ষা হইছে। সবই আল্লার ইশারা।
আমি বললাম, মার খেয়ে তুমি তো মনে হয় খুশিই হয়েছ।
ছুনু বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, মাইর তো স্যার খাওন লাগবই। অতবড় একটা। ক্ষমতা।
এই ক্ষমতায় কি তুমি খুশি?
লোকজন আমারে সমীহ করে। যখন পথে হাঁটি আঙুল উঁচাইয়া দেখায়–বড় ভাল লাগে! এই যে আফনে আমারে আদর কইরা ফিলটার ছিটে দিলেন, আমি খাইলাম, এই গুলান হইল আমার ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা না থাকলে কে আমারে। পুছতো?
তুমি কি নিশ্চিত তোমার ক্ষমতা আছে?
চুনু মিয়া প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল। আনন্দিত গলায় বলল, নিজের কথা নিজের মুখে বলা ঠিক না, গুনাহ হয়। আল্লাহপাক বেজার হন। দশ জনেরে জিজ্ঞেস করেন, তারা বলব। আর যদি অনুমতি দেন তা হইলে চোউক্ষের একটা খেলা দেখাইয়া দিমু।
চোখের খেলা দেখার জন্যে আমি তেমন আগ্রহ দেখালাম না। এই সব আধিভৌতিক ব্যাপারকে প্রশ্রয় যত কম দেয়া যায় ততই ভাল। পিশাচ ও ডাইনীদের যুগ পেছনে ফেলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। চাদে মানুষ পৌঁছে গেছে, কিছুদিন পর পৌঁছবে মঙ্গল গ্রহে। এই সময় চোখ লাগা নিয়ে মাথা ঘামানো শুধু হাস্যকর না, অপরাধও।
পরদিন দুপুরে ছুনুর সঙ্গে আমার আবার দেখা। গনি সাহেবকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছি। হঠাৎ দেখি, খালের পাড় থেকে ছুনু কচুর লতি সংগ্রহ করছে। ছুনুর গায়ে আগের দিনের পোশাক নেই। ময়লা লুঙ্গি, খালি গা। চোখে সানগ্লাসও নেই। ছুনুর সঙ্গে বার-তের বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে। ছুনুর তুলনায় তার মেয়েটার পোশাক পরিপাটি। ফ্রকটা সুন্দর এবং পরিষ্কার। মাথার চুল বেণী করে বাধা। এই বোধহয় ছুনুর বৃত্তি পাওয়া মেয়ে। আমি বললাম, কে, ছুনু না?