আসিফ বলল, আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিন।
না, তোমাকে সুযোগ দেয়া হবে না। তুমি আমার কথা শোন। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে কি লেখালেখি হচ্ছে সেই সম্পর্কে কোন ধরাণা ছিল না। দেশে এসে শুনলাম ইমদাদুল হক মিলন নামে একজন খুব লেখালেখি করছেন। মেলাতে আমি তাঁর বই কিনলাম। একটি বই পরাধীনতা পড়ে আমার এত ভাল। লাগল যে আমি সেই পরাধীনতা নিয়ে দীর্ঘ একটা প্রবন্ধ লিখলাম দৈনিক বাংলায়। তখনো এই লেখকের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় হয়নি। কাজেই তুমি বলতে পার না আমার ভেতর কোন হিপোক্রেসি আছে।
দুটি উদাহরণ দিয়েই আপনি আপনার দায়িত্ব শেষ করেছেন। সেটা কি ঠিক হচ্ছে? আপনি কি এই প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে আপনার দায়িত্ব পালন করেন? নিয়মিত তাদের লেখা পড়েন? তাদের উৎসাহ দেন? তাদের বিকশিত হতে সাহায্য করেন?
মা আমাকে স্বীকার করতে হল, আমি তা করি না। আমি তাকে হাসতে হাসতে বললাম, দায়িত্বে অবহেলার এই ব্যাপারটা আমি শিখেছি আমার অগ্রজদের কাছ থেকে। শওকত ওসমান স্যারের কথাই ধরা যাক। আমার শিক্ষক। ঢাকা কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন। তার চোখের ওপর আমি লেখালেখি শুরু করেছি। তার সঙ্গে যখন দেখা হয়, তিনি আমার লেখালেখি সম্পর্কে অনেক ভাল কথা বলেন, কিন্তু কথা হচ্ছে, এই কুড়ি বছরে তিনি সাহিত্য-বিষয়ক অনেক কিছুই লিখেছেন কিন্তু। কোথাও হুমায়ূন আহমেদ এই নামটি নেই।
এ প্রসঙ্গক্রমে কবি শামসুর রাহমান সাহেবের কথা বলি। অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের বাড়িতে আমি, কবি শামসুর রাহমান, দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী এবং হুমায়ূন আজাদ আড্ডা দিচ্ছি। আমি এক পর্যায়ে কবিকে বললাম, নির্মলেন্দু গুণকে কবি হিসেবে আপনার কোন স্তরের মনে হয়? কবি শামসুর রাহমান আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন–শুধু আপনাকেই বলছি–বাইরে কোট করবেন না– নির্মলেন্দু গুণকে আমার খুব বড় মাপের কবি বলে মনে হয়। আমি হতভম্ব হয়ে আমার দেশের প্রধান কবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি যদি কাউকে বড় কবি মনে করেন তাহলে তা প্রকাশ করতে অসুবিধা কি? কেন এটা তাকে ফিসফিস করে বলতে হবে? তিনি হয়ত ভেবেছেন, তাঁর বক্তব্যে অন্য কবিরা তার ওপর ক্ষেপে যাবেন। খুব ভুল ভাবেন নি। চারদিকের আবহাওয়া বিচার করে তাঁর মত কবি মত প্রকাশ করবেন? কবিরা দেশের আত্মা, তারপরেও এত দ্বিধা?
কাকের মাংস কাকে খায় না, লেখকের মাংস লেখক খায়। বেশ মজা করেই খায়। ঈর্ষা নামক ব্যাপারটা বোধহয় সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যুক্ত। এই ঈর্ষার জন্যেই হয়ত আমরা একজন অন্যজনকে অস্বীকার করি।
হাসন উৎসবে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম। প্রথম দিন হাসন রাজার গান হল। পরের দিন কবিদের অনুষ্ঠান। যেসব কবি আসবেন নিমন্ত্রণপত্রে তাদের নাম ছাপা হয়েছে। একজন কবি সেই অনুষ্ঠানে এলেন না, কারণ তার নামের আগে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নাম ছাপা হয়েছে। তিনি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সিনিয়র, তার নাম আগে যাওয়া উচিত ছিল। হায় রে সিনিয়রিটি! মহাকাল সিনিয়রিটি দেখে না। সে তার কঠিন পাল্লায় সবকিছু মাপে। সেই মাপে ভুল হয় না।
আমরাই শুধু তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাতামাতি করি। কচ্ছপের খোলসের ভেতর নিজেকে নিয়েই শুধু বাস করতে চাই। এই খোলস ছেড়ে আমাদের বেরুবার উপায় নেই, কারণ খোলসবিহীন কচ্ছপ পৃথিবীতে দেখা যায় না।
আমি নিজেও একটা শক্ত খোলসে নিজেকে আটকে ফেলেছি। নতুন প্রজন্মের শক্তিমান লেখকরা খোলসমুক্ত হবেন–এই আমার শুভ কামনা। আমার অগ্রজরা। এবং আমরা যে ভুল করেছি তারা তা করবেন না। বাংলা সাহিত্যকে অনেক দূর এগিয়ে। নেবার দায়িত্ব তাদের। যে মশাল আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি, সেই মশাল তাঁরা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছুটতে শুরু করবেন। শুধু মনে রাখবেন–তাঁদের কচ্ছপ হওয়া চলবে না। কচ্ছপরা ছুটতে পারে না।
খেলা
আমার বন্ধু কন্যা লীনা টেলিফোন করেছে। তার গলার স্বর ভারী ও বিষণ্ণ। আমি বললাম, কি হয়েছে রে? সে বলল, চাচা, আজ কি কোন কারণে আপনার মন খারাপ? আমি অবাক হয়ে বললাম, কই, না তো।
ঠিক মত ভেবে তারপর বলুন। হুট করে বলবেন না।
না, আমি ভালই আছি। আমার মন খারাপ করার মত কিছু কি ঘটেছে?
বাংলাদেশ যে মালদ্বীপের সঙ্গে ফুটবল খেলায় ড্র করলো এতে আপনার মন খারাপ হয়নি?
ও আচ্ছা, তা মন খারাপ কিছুটা হয়েছে।
আপনি কি এই মন খারাপের কারণে আপনার মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন?
ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব কেন? ওরা তো আর ড্র করেনি।
তাহলে বাবা কেন আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে? বাবা কেন শুধু শুধু। আমাকে চড় মারলো?
টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ আসতে লাগলো। হাউমাউ ধরনের কান্না। এতক্ষণে রহস্য ভেদ হলো। বোঝা যাচ্ছে, মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করার পর আমার বন্ধু রফিকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাড়িতে মারধোর শুরু করেছে। রফিকের ক্ষেত্রে এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক। ফুটবল আছে তার শয়নে, স্বপনে। চিন্তায় ও নিদ্রায়। লীগের খেলা হচ্ছে আর সে মাঠে নেই, এ হতেই পারে না।
তার পাল্লায় পড়ে একবার লীগ ফাইন্যাল দেখতে গিয়েছি। তার প্রিয় দল তেমন সুবিধা করতে পারছে না। তাকিয়ে দেখি তার চেহারা বিবর্ণ। বিড়বিড় করে কি সব দোয়া পড়ছে। এক সময় সে তার পাঞ্জাবির সব বোতাম খুলে ফেলল। পায়জামার। ফিতার গিট আলগা করে দিল। আমি হতভম্ব। হচ্ছে কি? রফিক বলল, কসাইত লেগে গেছে। এই সব করলে কু কাটা যায়।