এবারে শবে বরাতে ভেবেছিলাম বাচ্চাদের কিছু তারাবাতি কিনে দেব। কোথাও তারাবাতি পেলাম না। শুনলাম সরকারী নির্দেশে পটকার দোকান নিষিদ্ধ। খোলা বাজারে পাওয়া যাবে না। তবে বন্ধ বাজারে পাওয়া যাবে।
বন্ধ বাজার খোঁজার ইচ্ছা হলো না। তবে যাদের খোঁজার তারা ঠিকই খুঁজে বের। করল। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হল তাণ্ডব। পটকা তো নয়, যেন এটম বোমা ফাটছে। একেকটা পটকা ফুটে ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা কেঁপে উঠে। সেই সঙ্গে চলল মাইক। প্রার্থনা খুবই ব্যক্তিগত বিষয়, নীরব বিষয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে সেই ব্যক্তিগত নীরব প্রার্থনা সরব আকার ধারণ করল। যা শুরু হল তার নাম প্রার্থনা নয়, কোরান পাঠ নয়–তার নাম হট্টগোল।
আমি আমার এলিফেন্ট রোডের এ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বসে আছি, নতুন দিনের শবে বরাত উৎসব পালন দেখছি। এ কি ভয়াবহ উৎসব! হচ্ছেটা কি?
অনেকগুলি খণ্ড দৃশ্য দেখলাম। একটা বর্ণনা করি। রাত এগারটা কিংবা সাড়ে এগারটা। এলিফেন্ট রোড ধরে এক ভদ্রলোক তার কন্যা কিংবা কন্যা-স্থানীয় কাউকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মাটি খুঁড়ে কোত্থেকে একটা ছেলে এসে রিকশাওয়ালার সামনে বিকট শব্দে একটা বোমা ফাটাল। রিকশাওয়ালা রিকশা থামাল। তখন শুরু হল বৃষ্টির মত বোমা বৃষ্টি। রিকশার চারদিকে ফাটছে। মেয়েটি কাঁদছে। মেয়ের সঙ্গী হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে ছেলেগুলির দিকে তাকাচ্ছেন। ছেলেরা ক্ষমা করবে কেন? তারা ক্ষমা করতে আসেনি, তারা এসেছে মজা করতে। কাজেই তারা মজা করেই যেতে লাগল।
আমেরিকায় হেলোইন উৎসব বলে একটা উৎসব হয়। ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চারা ভূতের মুখোশ পরে বাড়ি বাড়ি যায়। কলিংবেল টিপে বলে–ট্রিট অর ট্রিক (কিছু দাও নয়ত ভয় দেখাব)। ঘরের লোকজন ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে তাড়াতাড়ি মুঠো ভর্তি চকোলেট এনে দেয়। সেই মজার উৎসবের ভয়াবহ বিবর্তন হয়েছে। আজ হেলোইন উৎসবের কথায় আমেরিকাবাসী আঁতকে উঠে। প্রতি স্টেটে স্পেশাল পুলিশ ফোর্স নামানো হয়। কারণ বর্তমানের হেলোইন উৎসবে মজা করার জন্যে বাড়িতে লোককে বাইরে থেকে ঘরে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। উৎসবটা এখন আর মজার ভয় দেখানো পর্যায়ে নেই। এখন ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলার পর্যায়ে। হেলোইন উৎসবের পর পর আমেরিকার খবরের কাগজগুলি উৎসবে হত্যার সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই সংখ্যা পড়ে যে কোন মানুষ আঁতকে উঠবেন।
আমেরিকা যে পথে যাবে–আমারও তো সেই পথেই যাব। নয়তো সভ্য বলে নিজেদের পরিচয় দেব কি করে? শবে বরাতের বলি শিরোনামে কাগজ এখন খবর ছাপা শুরু করেছে। ভোরের লাগজ লিখেছে–গ্রেপ্তার ৬০০, আহত ৩৬৫। সবে শুরু।
ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে!–ভবিষ্যতের শবে বরাত উৎসবে স্পেশাল পুলিশ বা রায়ট পুলিশ চলবে না–আর্মি নামাতে হবে, ট্যাঙ্ক নামাতে হবে। ধর্মীয় উৎসব কি ভাবে পালন করতে হয় আমরা তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে ছাড়ব।
কচ্ছপের গল্প
ঔপন্যাসিক আসিফ নজরুল সেদিন আমার বাসায় এসেছে। গম্ভীর চেহারার একজন ছেলে। নিজের ওপর তার আস্থা সীমাহীন। কাটা কাটা কথা বলে আশপাশের মানুষদের চমকে দেয়ার সূক্ষ্ম চেষ্টা আছে। মানুষকে চমকে দিয়ে কথাশিল্পী মাত্রই আনন্দ পান। আসিফ তার ব্যতিক্রম হবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই। ব্যতিক্রম কিছুটা আছে। তার কথায় অন্যকে আহত করার চেষ্টা আছে।
যাই হোক, তাকে আমি আনন্দিত স্বরে বললাম, কি খবর?
সে আমার আনন্দিত স্বরকে তেমন পাত্তা দিল না। কঠিন গলায় আমার স্ত্রীকে বলল, আচ্ছা ভাবী, হুমায়ূন ভাই কি হিপোক্রেট?
গুলতেকিন হকচকিয়ে গিয়ে বলল, কই না তো! ও যা বিশ্বাস করে তাই তো বলে। ভান তেমন করে না তো!
ভাবী, উনার ওপর একটি বই বের হয়েছে ঘরে বাইরে হুমায়ূন আহমেদ–আপনি কি সেটি পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার চোখে পড়েছে–প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করলেন–বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস সম্পর্কে কিছু লেখা হয়নি–আপনি নিজে কেন লিখছেন না?
হ্যাঁ, চোখে পড়েছে।
তার উত্তরে হুমায়ূন ভাই যা বললেন তার ভেতরে হিপোক্রেসি কি আপনি ধরতে পারেননি?
না তো।
আপনার ধরতে পারার কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস সম্পর্কে কোন উপন্যাস লেখা হয়নি এটা হুমায়ূন ভাই স্বীকার করে নিয়েছেন–কিন্তু তিনি জানেন। আমার একটি উপন্যাস এই প্রসঙ্গে আছে–নিষিদ্ধ কয়েকজন। তিনি বইটি পড়েছেন, তিনি আমাকে বলেছেন বইটি তার ভাল লেগেছে। অথচ ইন্টারভ দেয়ার সময় এই ব্যাপারটা তিনি উল্লেখ করেননি। এটা এক ধরনের হিপোক্রেসি নয়?
গুলতেকিন বলল, ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলে অবশ্যই হিপোক্রেসি।
ব্যাপারটা যে হিপোক্রেসি নয় আমি তা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম—প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় কখনো খুব ভেবেচিন্তে দেয়া হয় না। যা মনে আসে তাই বলা হয়। নিজেকে ডিফেণ্ড করার একটা চেষ্টা থাকে। অন্য কারোর কথা মনে থাকে না। তোমার নিষিদ্ধ কয়েকজনের কথা সেই কারণেই উল্লেখ করা হয়নি। তবে তোমার ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, আমি আমার একটি বই তোমাকে উৎসর্গ করেছি।
আসিফ আরো কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে নিজেকে তৈরি করল–তার চোখ তীক্ষ্ণ হল এবং ভুরু খানিকটা কুঁচকে গেল। আমি তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম–
তুমি লেখালেখি শুরু করেছ মাত্র দুতিন বছর হলো। এর মধ্যেই আমি তোমাকে একটি বই উৎসর্গ করেছি। আর আমার অবস্থাটা দেখ, আমি কুড়ি বছর ধরে লেখালেখি করার পর আমাকে বই উৎসর্গ করলেন কবি শামসুর রাহমান এবং সৈয়দ শামসুল হক। তাঁরা যে আমার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এই কাজটি করলেন তাও কিন্তু না। আমি তাদের বই উৎসর্গ করেছিলাম, তারা ভদ্রতা করেছেন, উৎসর্গ ফেরত দিয়েছেন। তুমি আমাকে বই উৎসর্গ করবে, তার উত্তরে আমি করব তা কিন্তু হয়নি–আমি তোমার বই উৎসর্গের জন্যে অপেক্ষা করিনি।