আমি নিচু গলায় বললাম, কবর খোঁড়ার মধ্যে সুন্দর-অসুন্দর কি আছে?
আমার নির্বুদ্ধিতায় আবারো সবাই বিরক্ত হলেন।
মানুষের আসল বাড়ি কবর। সেই বাড়িটা সুন্দর করে বানাতে হবে না? দালানকোঠা সুন্দর করে বানিয়ে ফয়দা কি?
জালাল উদ্দিন এসে পৌঁছলেন রাত দশটায়। রোগা পাতলা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। পানের ব্যবসা করেন। তুচ্ছ ধরনের ব্যবসা। কেউ তাকে পোছে না। কিন্তু কারো মৃত্যু হলে সবাই তার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জালাল উদ্দিনকে লাগবে। যেখান থেকে পার তাকে ধরে আন।
তিনটা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে কবর খোড়া শুরু হল। আমি গভীর আগ্রহে কবর খোড়া দেখছি। জালাল উদ্দিন মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে তুলছেন। মনে হচ্ছে কাজটায় তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। এক সময় মুখ তুলে হাসিমুখে বললেন, ফজলুর ভাগ্য ভাল। মাটি ভাল পাইছি। সচরাচর এমন ভাল মাটি পাওয়া যায় না।
মেয়েদের মধ্যে কে যেন এদিকে এসে পড়ল। তাকে প্রচণ্ড ধমক দেয়া হল। মেয়েদের কবর খোঁড়া দেখতে নেই। এটা পুরুষদের কাজ। কবর খোঁড়া শেষ হল রাত একটায়। জালাল উদ্দিন তার কাজ শেষ করে উঠে পড়লেন। হ্যাজাকের আলো ফেলা হল কবরে। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম–এটা সামান্য গর্তবিশেষ নয়। এ এক শিল্পকর্ম। পৃথিবীর অন্যান্য শিল্পকর্মের মত এই শিল্পকর্মের দিকেও মুগ্ধ হয়ে তাকানো যেতে পারে।
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ফজলুর ভাগ্য আসলেই ভাল। কবরটা যেন। হাসতেছে।
আমি বললাম, আমি একটু কবরে নেমে দেখতে চাই।
কেউ কোন আপত্তি করল না। শুধু বলা হল যেন অজু করে নামা হয়। আমি অজু করে কবরে নেমেছি। আমার চারদিকে মাটির দেয়াল। যারা উপরে আছে তাদের কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার মনে হল–আমাকে যেন আলাদা করে ফেলা হয়েছে–এই পৃথিবী, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথির সঙ্গে আর আমার কোন যোগ নেই।
জীবনে কোন বড় ধরনের অতিপ্রাকৃত অনুভূতির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। সেই মধ্যরাত্রের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই প্রথম এবং এ পর্যন্ত শেষ। অভিজ্ঞতা।
একালের শবে বরাত
আমি যখন ছোট ছিলাম তখনো শবে বরাত উৎসব হতো, এখনো হচ্ছে। তবে উৎসব পালন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। একালের ছেলেমেয়েদের আমাদের সময়কার উৎসবটির কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
আজ আইন করে পটকা ফুটানো নিষেধ করা হচ্ছে। আমাদের সময়ে এই আইনের প্রয়োজন হয়নি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পটকার দোকান। ছোটদের প্রিয় ছিল তারাবাতি, কাঠির আগায় পটকা, মার্বেল পটকা। একটু বখাটে ধরনের ছেলেদের জন্যে মরিচ বাতি। কাঁচা মরিচ সাইজের হাউই। দেয়াশলাই-এ আগুন লাগাতে হয়–আগুন লাগানোমাত্র শাঁ করে আকাশে উড়ে যায়।
সে সময় ছেলেমেয়েদের বাবারা পটকা কিনে দিতেন। কিছু তারাবাতি, কিছু লাঠিপটকা, কিছু মার্বেল পটকা। মনে আছে কাঠি-পটকা হাতে আমরা গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুক্ষণ পর পর গোণা হত–মোট কটা পটকা আছে। তারাবাতির। প্যাকেট থাকত বুক পকেটে। যখন-তখন পকেট থেকে তারাবাতির প্যাকেট বের করে বাতির সংখ্যা গোণা ছিল অবশ্যকর্তব্যের একটি।
পটকার দোকানে মোমবাতিও বিক্রি হত। শবে বরাতের সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা। হালুয়ার ব্যাপারটা ছিল কিনা মনে পড়ছে না, হয়তো ছিল। তবে। গোশত-রুটির কথা মনে আছে। চালের আটার রুটি এবং প্রচুর ঝাল দিয়ে ব্রাধা গরুর মাংস। ঝোলে কজি পর্যন্ত ডুবিয়ে রুটি খাওয়া শবে বরাতের অবশ্য করণীয় কর্মকাণ্ডের একটি।
রাতের খাওয়ার পরই গোসল। হাড় কনকনে শীতে গোসল সারতে হতো। গরম পানি না, পুকুরে। কারণ গোসল করে পাড়ে উঠার পর গা থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে যত ঘাস ভিজত তত সোয়াব। সোয়াব বাড়ানোর জন্যে ভেজা গায়ে ঘাসের উপর। ছোটাছুটি করার কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। ১ নামাজ শুরু হলো একটু রাত করে। মেঝেতে পরিষ্কার একটা চাদর বিছানো হতো। আমরা ছোটরা বাবার পেছনে নামাজে দাঁড়াতাম। ছোটদের নামাজ দরকার নেই।–বাবা যেমন করছেন তেমন করলেই সোয়াব। আমাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা মজার খেলার মত। সেজদায় গেলে মাথা থেকে টুপি পড়ে যেত। সেই টুপি চট করে মাথায় দেয়া এবং হাত বাড়িয়ে ছোট ভাইয়ের মাথা থেকে টুপি ফেলে দেয়াতেই সময় কাটত।
সারারাত নামাজ পড়তে হবে এই জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। যে কোন কারণেই হোক শবে বরাতের রাতে আমাদের খাটে নিয়ে শোয়ানো হতো না। নামাজের চাদরেই আমরা শুয়ে থাকতাম। শুধু চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যেত। আধোঘুম, আধো-জাগরণে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতাম–বাবা নামাজ পড়ছেন। মা তার পাশেই রেহেলে কোরান শরীফ রেখে পাঠ করছেন। ইলেকট্রিক বাতি নিভিয়ে ঘরে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। আগরদানে আগরবাতি পুড়ছে। যেন অলৌকিক এক দৃশ্য। বাবা নামাজের ফাঁকে ফাঁকে উঠে এসে তার পুত্র-কন্যাদের গায়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। দীর্ঘ ফু–মাথা থেকে পা পর্যন্ত। আবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। শবে বরাত এলেই মনে পড়ে এই মঙ্গলময় ফুঁ দেয়ার জন্যে বাবা বেঁচে নেই। মন বিষণ্ণ হয়।
প্রতি শবে বরাতের রাতেই বাবার স্মৃতি মনে করেই হয়তো গভীর রাতে আমার। বাসাতেও মেঝেতে একটা ঢালাও বিছানা করা হয়। বাবার মত নামাজ পড়ে প্রার্থনা করি। কিন্তু কিছুতেই সেই আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারি না।