আমার ভাবতে ভাল লাগে, এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের দেশের সব মানুষ লিখতে জানবে, পড়তে জানবে। এটা তেমন কোন কঠিন ব্যাপারও নয়। যদি আইন করে দেয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা উচ্চশিক্ষা নিতে আসবে তারা অতি অবশ্যই দুজনকে লিখতে এবং পড়তে শিখিয়ে তারপর আসবে।
সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে আসার জন্যে এটা হবে অবশ্যপালনীয় শর্ত।
অনেক কঠিন কঠিন কথা বলে ফেললাম–একটা গল্প বলে শেষ করি। আমরা। তখন বগুড়ায় থাকি। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। হাতে প্রচুর অবসর। দিনরাত। গল্পের বই পড়ি। একদিন সতীনাথ ভাদুড়ির অচিন রাগিণী পড়ছি। পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেল। লজ্জিত হয়ে চোখ মুছছি। তখন দেখি, আমাদের বাসার ঠিকা কি অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। সে বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলে–এমন কি আছে এখানে যা পড়ে একজন কাঁদতে থাকে? বইয়ের ভেতর কোন দুঃখ ভরে দেয়া হয়েছে?
আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না। সে বইটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইল। আমি বইটা তার হাতে দিলাম। সে নেড়ে চেড়ে দেখল। গন্ধ শুকল। আমার মাকে গিয়ে বলল, দাদা যখন বই পড়তে পড়তে কান্দে তখন যে কি সুন্দর লাগে!
পাঠকের এই সৌন্দর্য আমরা অবশ্যই সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেব। এই দিন তো দিন নয় আরো দিন আছে। এই দিনেরে নেব আমরা সেই দিনেরো কাছে।
একদিন চলিয়া যাব
আমার বড় মামা খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যা পেতেছেন। তিনি শেষবারের মত তার সব প্রিয়জনদের দেখতে চান, এই খবর পেয়ে আমি ছুটে গেলাম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। মামার সঙ্গে দেখা হল না। আমি পৌঁছলাম বিকেলে, তিনি মারা গেলেন সেইদিন সকালে। মৃত্যুশোকে পাথর হয়ে আছে আমার নানার বাড়ি। গিজ গিজ করছে মানুষ। মেয়েরা সুর করে কাঁদছে। মাদ্রাসার তালেবুল এলেমরা চলে এসেছে–তার কোরান পাঠ শুরু করেছে।
আমি প্রচণ্ড শোকেও চাপা এক উৎসবের ছোঁয়া পেলাম। বড় কোন উৎসবের। আগে যে উত্তেজনা থাকে, যে ব্যস্ততা থাকে–এখানেও তাই। মুরুব্বিরা উঠোনে গোল। হয়ে বসে আছেন। তারা গম্ভীর মুখে তামাক টানছেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাদের কাছ থেকে আসছে। মরা বাড়িতে তিনদিন কোন আগুন জ্বলবে না। খাবার আসবে বাইরে থেকে। এই খাবারের নাম তোলা খাবার। কোন কোন বাড়ি থেকে এই খাবার আসবে। তার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। তোলা খাবার সবাই পাঠাতে চায়। কিন্তু সবার খাবার। নেয়া যাবে না। সামাজিক মানমর্যাদার ব্যাপার আছে। এ খান সাহেবের বাড়ি থেকে একবেলা তোলা খাবার পাঠানোর প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাবে সবাই বিব্রত। এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যাচ্ছে না, আবার তাদের না বলাও যাচ্ছে না। তারা ক্ষমতাশালী। এই ভয়াবহ (!) সমস্যার সমাধান বের করার জন্যে মুরুব্বিরা। নিচু গলায় ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। তামাক পুড়ছে প্রচুর।
মুরুব্বিদের দ্বিতীয়দল (এরা অনেক বয়স্ক। এদের কেউ কেউ অথর্ব পর্যায়ে চলে গেছেন। চলচ্ছক্তি নেই, চোখে দেখেন না–এমন ) অন্য সমস্যা নিয়ে বসেছেন–কে গোসল দেয়াবে? মড়ার গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিলে তো হবে না। জটিল নিয়ম কানুন আছে। সবাই এইসব নিয়ম জানে না। যে জানে তাঁকে দিয়ে গোসল দেয়ানো যাবে না, কারণ সে শরাব খায়–এরকম গুজব সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে। মুরুব্বিদের একজন বললেন, আচ্ছা ফজলু কি মৃত্যুর আগে কিছু বলেছে–কে তারে। গোসল দিব? বা কবর কোনখানে হবে?
না, বলে নাই।
বলে গেলে কাজকর্মের সুবিধা হয়। বলে যাওয়া উচিত।
এ মৃতের উপর রাগ করা যায় না, তবে মৃতের বোকামির জন্যে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হওয়া। যায়।
ভেতর বাড়ি থেকে মেয়ের চিৎকার করে কাঁদছে। এত উঁচু স্বরে বিলাপ শরিয়তে নিষেধ করা হয়েছে। তাদেরকে গলা নিচু করতে বলা হল। তালেবুল এলেমরা কোরান শরীফ এত মাধা গলায় পড়ছে কেন? গলায় জোর নাই? তাদের মৃদু ধমক দেয়া হল।
আত্মীয়স্বজন সবাই কি খবর পেয়েছে? ভুলক্রমে কাউকে খবর না দেয়া হলে বিরাট জটিলতা হবে। যাদের খবর দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কারা কারা উপস্থিত হয়েছে? সবাই উপস্থিত না হলে জানাজার সময় ঠিক করা যাবে না।
কবর দিতে দিতে হবে আসরে নামাজের পর পর। দেরি করা যাবে না। কবর দিতে দিতে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে যাবে। মসজিদে মাগরেবের নামাজ আদায়। করে গোরযাত্রীরা ঘরে ফিরবে।
কবরের জায়গা কি ঠিক হয়েছে?
হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। বাড়ির পেছনে। গোরস্থানে কবর হলে মেয়েছেলেরা যেতে পারে না। মৃত ছেলের মা ছেলের কবর ঘরের পাশে চাচ্ছেন, যাতে তিনি যখন-তখন যেতে পারেন।
মসজিদের লাগোয়া গোরস্থানে কবর হলেই ভাল হত। তবু মার ইচ্ছাই বড়। বাড়ির পেছনে কবর খননের অনুমতি দেয়া হল। তখনই আসল সমস্যা দেখা দিল। যে কবর খুড়বে সে নেই। সে গিয়েছে শম্ভুগঞ্জ, তার মেয়ের বাড়ি। কি সর্বনাশ। শম্ভুগঞ্জ থেকে তাকে ধরে আনার জন্যে তৎক্ষণাৎ লোক ছুটল। মনে হচ্ছে বাদ আছর কবর হবে না। বিলম্ব হবে। উপায় কি? আল্লা আল্লা করে ঐ লোককে পাওয়া গেলে হয়।
আমি ভেবে পেলাম না, মোহনগঞ্জের মত এত বড় একটা জায়গায় কবর খোড়ার কি একজনই মানুষ? আমার অজ্ঞতায় সবাই মজা পেলেন। আমাকে জানানো হল, জালাল উদ্দিন কবর খোড়ার ব্যাপারে অঞ্চল-বিখ্যাত। তার মত সুন্দর করে কেউ কবর খুঁড়তে পারে না। তাকে না পাওয়া গেলে এক কথা। পাওয়ার সম্ভাবনা যখন আছে চেষ্টা করা যাক।