ছফা ভাই ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট পেলেন। তিনি উঠে এলেন হোস্টেলে। আমি থাকি মুহসীন হলে। নিয়ম করে আমি এবং আমার বন্ধু আনিস সাবেত প্রতি রাতে তাঁর কাছে যাই। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়। আড্ডা মানে ছফা ভাই কথা বলেন, আমরা দুজন শুনি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কথা। তিনি মহাকবি গ্যাটের রচনার বাংলা অনুবাদে হাত দিয়েছেন। অনুবাদ পড়ে শোনান।
একবার তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি, তিনি বিশাল এক বাদ্যযন্ত্র কিনেছেন। সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস। দেখতে নিচু আলমারির মতো। ছফা ভাই জানালেন, প্রতি রাতেই তাঁর মাথায় নানা ধরনের সুর আসছে। সুর ধরে রাখার জন্যই এই বাদ্যযন্ত্র।
আমি বললাম, ছফা ভাই! আপনি বাজাতে পারেন?
ছফা ভাই বললেন, অবশ্যই পারি।
তিনি বাদ্যযন্ত্রটার রিড টিপতে লাগলেন। বিচিত্র শব্দ হচ্ছে। তিনি পায়ে তাল দিচ্ছেন এবং মাথা নাড়ছেন।
এই সময় তিনি গান লিখতে শুরু করলেন। গান লিখে সঙ্গে সঙ্গে সুর দিয়ে দেন। আমি এবং আনিস সাবেত অবাক হয়ে সেই সঙ্গীত শুনি।
হঠাৎ একদিন শুনি ছফা ভাই দেশে নেই। গাদ্দাফির নিমন্ত্রণে লিবিয়া চলে গেছেন। লিবিয়ায় বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। তাঁর মাথায় রঙিন গোল টুপি। আমাদের জানালেন, গাদ্দাফি নিজের হাতে তার মাথায় এই টুপি পরিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গাদ্দাফির গ্রিন বুক অনুবাদের। ছফা ভাইয়ের অনেক কথাই কল্পনারাজ্যের। তবে এই কথাটা হয়তো ঠিক। ছফা ভাইয়ের হাতে টাকাপয়সার নড়াচাড়া দেখা গেল। তিনি একটা প্রেস কিনে ফেললেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই প্রেস উঠেও গেল। ছফা ভাই কাঁধে একটা টিয়া পাখি নিয়ে ঘুরতে লাগলেন। তিনি নাকি টিয়া পাখির অনেক কথা বুঝতে পারেন।
একটা পর্যায়ে আমার ক্ষীণ সন্দেহ হওয়া শুরু হলো যে, তিনি যে জগতে বাস করেন তা সম্পূর্ণই তাঁর নিজের। বাস্তব জগৎ থেকে অনেকটা দূরের। তাঁর রিয়েলিটি এবং আমাদের রিয়েলিটি এক নয়।
কারো যখন মোহভঙ্গ হয় তখন অতি দ্রুতই হয়। আমি তার বলয় থেকে সরে গেলাম। আনিস সাবেত পিএইচডি করার জন্য আমেরিকা চলে গেলেন। ছফা ভাই তার জন্য নতুন বলয় তৈরি করলেন। তিনি শূন্যস্থান পছন্দ করেন না।
ছফা ভাইকে নিয়ে আমার অসংখ্য স্মৃতি আছে। তার ওপর দুশ’ পাতার একটা বই আমি অবশ্যই লিখতে পারি। এখানে একটি স্মৃতি উল্লেখ করছি। ১৯৮৫ বা ৮৬ সালের কথা। এতদিন লেখালেখির জগতে থেকেও ছফা ভাই বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান নি। আমি পেয়েছি অথচ ছফা ভাই পান নি, খুবই লজ্জিত বোধ করি। কীভাবে কীভাবে আমি তখন বাংলা একাডেমীর কাউন্সিলারদের একজন। পুরস্কার কমিটিতে আছি। আমি জোরালোভাবে ছফা ভাইয়ের পুরস্কারের ব্যাপারটা বললাম। যথারীতি তা নাকচও হয়ে গেল। আমি ছফা ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করেছি—এই খবর ছফা ভাইয়ের কানে পৌঁছল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তার বাসায় উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, হুমায়ুন, আপনার এত বড় স্পর্ধা যে আপনি আমার জন্য সুপারিশ করেন!
আমি চেয়ারে বসেছিলাম। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম।
ছফা ভাই বললেন, আমি বসতে না বলা পর্যন্ত এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
আপনি আর কখনোই আমার বাসায় আসবেন না।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
ছফা ভাইয়ের সঙ্গে এটাই সম্ভবত আমার শেষ দেখা। ভুল বললাম, আনিস সাবেত ক্যান্সারে মারা যাওয়ার সংবাদ দিতে আমি আরো একবার তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর ‘আনিসরে’ ‘আনিসরে’ বলে চিৎকার করে কাঁদলেন।
কান্না বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের ভুবনে ঢুকে গেলেন। চলে গেলেন রিয়েলিটির বাইরে। আনিস সাবেত ট্রাস্টি বোর্ড করতে হবে। সেই ট্রাস্টি দুস্থ লেখকদের বৃত্তি দেবে। দরিদ্র লেখকদের বই প্রকাশনার দায়িত্ব নেবে। ট্রাস্ট ফান্ড একটা আধুনিক স্কুল করবে টোকাইদের জন্য।
তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক কারা কারা থাকবেন তাদের নাম লেখার জন্য। ট্রাস্টি বোর্ডের নীতিমালাও লিখতে হবে। তাঁকে দারুণ উত্তেজিত মনে হলো। তিনি লিখছেন, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি অন্যভুবনের মানুষটিকে।
আমাকে নিয়ে ছফা ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। আমি তাঁর কোনোটাই পূরণ করতে পারি নি। এত মেধা আমার ছিল না। প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা বৃত্ত থাকে। কেউ সেই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। আমিও পারি নি। ছফা ভাই নিজেও পারেন নি। তাকে বন্দি থাকতে হয়েছে নিজের বৃত্তেই।
খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
Why do people always expect authors to answer questions? I am an author because I want to ask questions. If I had answers I’d be a politician.
—Eugene Lonesco
খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির মালিক খান সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাকে যথেষ্ট বিরক্ত মনে হলো। তিনি নন্দিত নরকে উপন্যাসের প্রুফ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, বই হোট হয়েছে। বড় করতে হবে।
আমি বললাম, আমার গল্পটাই তো এতটুকু।
খান সাহেব বললেন, উপন্যাস ফর্মা হিসেবে লিখতে হয়। ফর্মা বুঝেন তো? ষোল পৃষ্ঠায় এক ফর্মা। আপনি একটা উপন্যাস লিখলেন তিন ফর্মা নয় পৃষ্ঠা। বাকি সাত পৃষ্ঠায় আমি কী করব? কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। এখানেই ঠিক করেন।