বরিশালের অনুষ্ঠান শেষ করে ঢাকায় ফিরেই আমি সব ভাইবোন এবং মাকে নিয়ে পিরোজপুর গোরস্থানে এসে উপস্থিত হলাম,
০৫.
When I’m writing I’m always aware that this friend is going to like this, or that another friend is going to like that paragraph or chapter, always thinking of specific people. In the end all books are written for your friends.
–Gabriel Garcia Marquoz
ঢাকা শহরে একজন ‘হন্টন পীর’ আছেন। তাঁর একমাত্র কাজ সারাদিন হাঁটা। একা হাঁটেন না। ভক্তদের নিয়ে হাঁটেন। একজন বাবার মাথায় ছাতা ধরে থাকে। একজনের হাতে থাকে পানির বোতল। অন্য একজনের হাতে কলার কাদি। বাবা খুব সম্ভব কলার ভক্ত। আমি বেশ কয়েকবার দূর থেকে এই হন্টন বাবাকে লক্ষ করেছি। একবার মিনিট পাঁচেক বাবার আশেপাশেই ছিলাম। উদ্দেশ্য বাবার ঘটনাটা কী জানা। বাবার জনৈক ভক্ত আমাকে চিনে ফেলে অবাক হয়ে বলল, আপনি বাবার কাছে কী চান? আমি বললাম, গল্প চাই!
আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দলবেঁধে তার পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন। ‘আমার বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ!’ আমরা গম্ভীর মুগ্ধতায় তার আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখতাম। তাঁর নাম আহমদ ছফা। আমাদের সবার ছফা ভাই।
ছফা ভাই ছিলেন আমার Mentor. এই ইংরেজি শব্দটির সঠিক বাংলা নেই। Mentor এমন গুরু যার প্রধান চেষ্টা শিষ্যকে পথ দেখিয়ে উঁচুতে তোলা। ছফা ভাই শুধু যে একা আমার Mentor ছিলেন তা না, অনেকেরই ছিলেন।
দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। শিশু রাষ্ট্র জন্মের যন্ত্রণায় তখনো ছটফট করছে। আর ছফা ভাই ছটফট করছেন আবেগে এবং উত্তেজনায়। কত অদ্ভুত অদ্ভুত পরিকল্পনা তার মাথায়। দেশকে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতে এভারেস্ট শিখরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। দেশ মেধা এবং মননে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। ইত্যাদি।
ছফা ভাই এমন একজন মানুষ যিনি তার উত্তেজনা নিমিষে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আমরাও ছফা ভাইয়ের মতোই উত্তেজিত হই। কল্পনায়। ভাসে ভবিষ্যতের অপূর্ব বাংলাদেশ।
ছফা ভাই সাপ্তাহিক একটা পত্রিকা বের করে ফেললেন। নিজেই সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রধান লেখক। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, গল্প লেখা শুরু করে দাও। রোজ রাতে একটা করে গল্প লিখতে হবে। আমার পত্রিকায় নিয়মিত গল্প ছাপা হবে। ছফা ভাইয়ের কথা মানেই আদেশ। আমি রাত জেগে গল্প লিখে ফেললাম। আজ আর সেই গল্পের নাম মনে নেই। গল্প কী লিখেছিলাম তাও মনে নেই। ছফা ভাইয়ের পত্রিকাটার কথাও মনে নেই। দুই-তিন সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। ছফা ভাই তখন দারুণ অর্থকষ্টে। থাকার জায়গা নেই। ক্ষীণ সম্ভাবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট পাবেন। পাচ্ছেন না। একদিন আমি ছফা ভাইকে ভয়ে ভয়ে বললাম, হলে সিট পাওয়া পর্যন্ত আমাদের বাসায় কি থাকবেন?
আমার মা তখন বাবর রোডে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রী হিসাবে একটা বাড়ির দোতলাটা বরাদ্দ পেয়েছেন। সেখানে না আছে পানির ব্যবস্থা, না আছে কিছু। ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হলেন। আমরা তাঁকে সবচেয়ে বড় কামরাটা ছেড়ে দিলাম। মা তার নিজের সন্তানদের যে মমতায় দেখেন, একই। মমতা ছফা ভাইয়ের দিকেও প্রসারিত করলেন।
ছফা ভাই বাইরে-বাইরেই থাকতেন, রাতে এসে শুধু ঘুমাতেন। বেশির ভাগ সময় বাইরে থেকে খেয়ে আসতেন। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া পরিবারটির ওপর বাড়তি চাপ হয়তো দিতে চান নি।
প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছফা ভাই কিছু সময় মা’র সঙ্গে কাটাতেন। গত রাতে যেসব স্বপ্ন দেখেছেন তা মাকে বলতেন। মার দায়িত্ব স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা। আমার ধারণা, ছফা ভাই স্বপ্নগুলি বলতেন বানিয়ে বানিয়ে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে মাকে খুশি করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আমার এরকম ধারণা হওয়ার কারণ হলো, ছফা ভাইয়ের স্বপ্নগুলিতে ডিটেলের কাজ খুব বেশি থাকত। স্বপ্নে এত ডিটেল থাকে না। একটা স্বপ্ন বললেই পাঠক বুঝতে পারবেন
কাকিমা, কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম দুটা কাক। একটা বড় একটা ছোট। ছোট কাকটার একটা নখ নেই। তার স্বভাব চড়ুই পাখির মতো। তিড়িং বিড়িং করে সে শুধু লাফায়। বড়টা শান্ত স্বভাবের। সে একটু পর পর হাই তোলার মতো করে। তাদেরকে ধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ ধান খাচ্ছে না। ধানগুলি ঠোঁটে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিচ্ছে। এখন কাকিমা, বলুন, স্বপ্নটার অর্থ কী? আমি বিরাট চিন্তায় আছি।
বলতে ভুলে গেছি, আমার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে কিন্তু এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ছফা ভাই। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির খান সাহেবকে পাঠিয়ে এই কাজটা করা। তখন তিনি লেখক শিবির নামক সংগঠনের প্রধান। তিনি লেখক শিবির থেকে নন্দিত নরকে উপন্যাসকে বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে পুরস্কারও দিয়ে দিয়েছেন। আমি অতি তরুণ ঔপন্যাসিক। আমার ওপর ছফা ভাইয়ের অনেক আশা। তার ধারণী, আমি অনেকদূর যাব। তিনি চেষ্টা করছেন আমার অনেকদূর যাত্রার পথ যেন সুগম হয়।