আমার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বাবা রাতে আমার হাতে একতোড়া কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে একটা নাটক আছে। রেডিও নাটক। আমি লিখেছি। নাম—কত তারা আকাশে। ঢাকা বেতারের একজন। প্রডিউসারের বাড়ি পিরোজপুরে। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, নাটক ভালো হলে প্রচারের ব্যবস্থা করবেন। তুই নাটকটা পড়ে দেখ। কোনো পরিবর্তন লাগলে করে ফেলবি।
আমি মহানন্দে নাটক কাটাকাটি করতে লাগলাম। একসময় জিনিস যা দাঁড়াল, তাকে আর বাবার লেখা নাটক বলা যায় না। বাবা নাটক পড়ে বললেন, অসাধারণ জিনিস দাঁড় হয়েছে। নাটক জমা দেয়া হলো। প্রডিউসার সাহেব আশ্বাস দিলেন, প্রচার হবে, তবে দেরি হবে।
দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার কারণে সব এলোমেলো হয়ে গেল। পিতাপুত্রের যৌথ নাটক প্রচার হলো না।
ছুটি শেষ হয়ে গেল। আমি বাক্সভর্তি কেমিস্ট্রি বই নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। শঙ্খনীল কারাগারের পাণ্ডুলিপি ফেলে এলাম। পাণ্ডুলিপি সঙ্গে রাখার কিছু নেই। বই হিসাবে শঙ্খনীল কারাগার প্রকাশিত হবে, পাঠক পড়বে, কোনো একদিন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় সেই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র বানাবে। সেই চলচ্চিত্র দেশে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের সম্মান পাবে, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে পাবে Honourable mention—এইসব কিছুই ঊনিশ বছরের যুবকটি জানত না।
স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পর মা এবং ভাইবোনদের নিয়ে পিরোজপুরে বাবার কবর জিয়ারত করতে গেলাম। মা এবং ভাইবোনরা খুব কান্নাকাটি করল। অদ্ভুত কোনো কারণে আমার চোখে পানি এল না। তাদের বাসায় রেখে সন্ধ্যাবেলা আমি আবার কবরস্থানে গেলাম। আমার সঙ্গে দু’টা বই নন্দিত নরকে, তোমাদের জন্যে ভালোবাসা। নিতান্তই ছেলেমানুষের মতো বই দুটা কবরের ঝোপঝাড়ের ভেতর রেখে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। মনে মনে বললাম, নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে।
বাবার কবরে শ্বেতপাথরে এই দু’টা লাইনই লেখা।
প্রায়ই ভাবি, আমার নিজের কবরে এপিটাফ হিসেবে কী লেখা থাকবে? লেখাটা কি আমিই লিখব? নাকি অন্য কেউ আমার হয়ে লিখে দেবে?
গায়ক আব্বাসউদ্দিনের কবর আজিমপুর গোরস্থানে। সেখানে এপিটাফ হিসাবে তার অতি বিখ্যাত গানের চরণ লেখা
বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু
কয়া কয়া যাও
যে ক’বার দেখেছি মনের ভেতরে গান গুনগুন করে উঠেছে।
এমন সুন্দর কোনো কিছু কেউ কি লিখবে আমার জন্য? কোনো পত্রিকা কি কোনো শোকগাথা প্রচার করবে? তারা কী লিখবে?
William Faulkner বলেছেন, একজন লেখকের obituary হওয়া উচিত এক লাইনের।
He wrote books, then he died.
মানুষটা বই লিখেছে, তারপর মারা গেছে।
বাহ্ চমৎকার। এর চেয়েও সুন্দর একটা কথা লিখি?
আমার প্রিয় লেখক Jorge Luis Borges বলেছেন—When writers die they become books, which is after all, not too bad an incarnation.
মৃত্যুর পর লেখকরা বই হয়ে যান।
এরচেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
পুনশ্চ : আমি যে পিতৃভক্ত ছেলে এই তথ্যটা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে পাঠকরা জেনেছেন। অতি সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন পিতৃভক্ত একজন ছেলে ত্রিশ বছর পর বাবার কবর দেখতে যায় কীভাবে? ঢাকা থেকে পিরোজপুর যেতে আট ঘণ্টা লাগে।
প্রশ্নটার জবাব আমার কাছে নেই।
সবার ব্যস্ততা। কেউ সময় বের করতে পারে না। কত কিছু। আমরা জটিল আধুনিক এক জগতে বাস করি।
তারপরেও ত্রিশ বছর পর হঠাৎ সবাইকে জড়ো করে কেন কবরস্থানে গেলাম গল্পটা বলা দরকার। এই গল্পে সামান্য Supernatural touch আছে।
বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে সবুজ সাথী নামের প্রেসক্রিপসন নাটক নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। এই সিরিয়ালটির লেখক এবং পরিচালক যেহেতু আমি, আমাকেও প্রতিটি অনুষ্ঠানে থাকতে হচ্ছে। খুলনার অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা যাচ্ছি বরিশালে। গাড়ি করে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আছেন আসাদুজ্জামান নূর, জাহিদ হাসান এবং অভিনেত্রী-গায়িকা শাওন। ত্রিশ বছর পর এই অঞ্চলে প্রথম যাত্রা। সবকিছু বদলে গেছে। আমি যাচ্ছি ঘুমুতে ঘুমুতে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। আমি প্রায় চেঁচিয়ে বললাম, ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান। গাড়ি থামান।
আসাদুজ্জামান নূর বললেন, সমস্যা কী, শরীর খারাপ লাগছে?
আমি বললাম, শরীর খারাপ না, তবে কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি অতিপরিচিত জায়গায় এসেছি।
গাড়ি থামল। আমি ঘোরলাগা অবস্থায় গাড়ি থেকে নামলাম। কিছুই চিনতে পারছি না। খুলনা-বরিশাল হাইওয়ের একটি অংশে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে খুব কাছে কোথাও আমার বাবার কবর।
জাহিদ বলল, কী বলেন হুমায়ূন ভাই?
শাওন বলল, উনি যখন বলছেন তখন একটু খুঁজে দেখলে হয়।
বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। একজন বলল, সামান্য পেছনে গেলেই পিরোজপুর গোরস্থান। আমি সবাইকে নিয়ে গোরস্থানে ঢুকলাম। আমরা কবর জিয়ারত করলাম। শাওন বলল, আমি আমার জীবনে অতি রহস্যময় একটা ঘটনা দেখলাম। ছেলে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে বাবা ছেলেকে ডেকে পাঠালেন।
সব ঘটনার পেছনেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে। আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। থাকলেও আমি তা জানি না।