এইটুকু লিখেই পরের লাইনে লিখলাম বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম।
Macromolecule-এর সঙ্গে বাসের কোনোই সম্পর্ক নেই। তারপরেও কেন লিখলাম!
বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাসার সামনে বিশাল পুকুর। পুকুর থেকে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির শব্দ আসছে। পিরোজপুর শহরে বৃষ্টি হওয়া মানেই কারেন্ট চলে যাওয়া। আমি সিরিয়াসলি পড়ছি ভেবেই আমার সামনে হারিকেন দেয়া হয়েছে। আমার মাথার ভেতর একের পর এক লাইন আসছে। এক ধরনের অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি লিখতে শুরু করেছি আমার প্রথম উপন্যাস—শঙ্খনীল কারাগার।
বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারা স্রোত। লোকজন চলাচল করছে না, লাইটপোস্টের বাতি নিবে আছে। অথচ দশ মিনিট আগেও যেখানে ছিলাম সেখানে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। শুকনা খটখট করছে চারদিক। কেমন অবাক লাগে ভাবতে, বৃষ্টি এসেছে, ঝুপ ঝুপ করে একটা ছোট্ট জায়গা ভিজিয়ে চলে গেছে। আর এতেই আশৈশব পরিচিত এ অঞ্চল কেমন ভৌতিক লাগছে। হাঁটতে গা ছমছম করে।
শঙ্খনীল কারাগার আমার প্রথম লেখা উপন্যাস, যদিও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকে। আমার পরম সৌভাগ্য, আমার বাবা শঙখনীল কারাগার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে যেতে পেরেছেন। সেই গল্প আরেকদিন করব।
০৪.
উনিশ বছর বয়সের অনেক তরুণ-তরুণী উপন্যাস লিখেছে। এটা এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার না। যেটা উল্লেখ করার মতো সেটা হচ্ছে, আমি লিখেছি খুব দ্রুত। তিন রাতের বেশি সময় লেগেছে বলে আমার মনে হয় না। উপন্যাস শেষ করেছি মধ্যরাতে। শেষ করার পর পর মনে হয়েছে–ইশ, কাউকে যদি পড়াতে পারতাম! এমন সুন্দর একটা গল্প। কেউ জানবে না?
সুন্দর একটা গল্প বলেছি এটা বুঝতে পারছিলাম। লেখার সময় প্রতিটি চরিত্র চোখের সামনে ভাসছিল। রাবেয়া আপা অনেকবার আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেছেন, প্রতিবারই তার কাঁচের চুড়ির শব্দ শুনেছি। কিটকি গায়ে চমৎকার সেন্ট মাখে। যতবার কিটকির কথা লিখেছি, ততবারই সেন্টের গন্ধ পেয়েছি। উপন্যাসের কিছু কিছু জায়গা লেখার সময় টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়েছে।
গল্প ভালো লিখেছি বুঝতে পারছি, কিন্তু উপন্যাস কি হয়েছে? উপন্যাস লেখার নিশ্চয়ই অনেক নিয়মকানুন আছে। আমি তো কিছুই জানি না।
উপন্যাস লেখার বিষয়ে সমারসেট মম বলেছেন—There are three rules for writing the novel. Unfortunately no one knows what they are.
তিন মাসের জন্য লেখালেখি শেখার একটা স্কুলে আমি ক্লাস করেছিলাম। আমার আগে সেই স্কুলে পশ্চিমবঙ্গের আরেক ঔপন্যাসিকও ক্লাস করেছেন। তাঁর নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। স্কুলটা হলো আমেরিকার আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভ রাইটিং ফ্যাকাল্টি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই স্কুল থেকে কিছু শিখতে পেরেছিলেন কি-না আমি জানি না। আমি কিছুই শিখতে পারি নি।
মনে আছে একদিন আমাদের শিক্ষক Idea বিষয়ে এক ঘণ্টার ক্লাস নিলেন। তিনি বললেন, কীভাবে Idea লালন করতে হয়। Idea-র পূর্ণতার জন্য সময় দিতে হয়।
তারপর idea-কে প্রকাশের উপায়গুলো নিয়ে ভাবতে হয়।
আমি মহাবিরক্ত হয়ে উসখুস করছি। শিক্ষকের সেটা চোখ এড়াল না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডক্টর আহমেদ (সব ছাত্রের নাম তিনি জানতেন), আইডিয়া বিষয়ে তোমার কি কিছু বলার আছে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং পরিষ্কার গলায় বাংলায় বললাম,
শিল্পীর শিরে কিলবিল করে আইডিয়া
উইপোকা বলে, চল ভাই তারে খাই গিয়া।
শিক্ষক বললেন, What does it mean?
আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাকে শোনাব, উইপোকার ইংরেজি কিছুতেই মাথায় আসছে না। শেষটায় বললাম
Creative person’s head is full with ideas
Little bugs say, let us eat them.
তিনি হতাশ গলায় বললেন, এখনো বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, আইডিয়া হলো ক্ষুদ্র পোকাদের আহার। এর বেশি কিছু না।
পুরনো কথায় ফিরে যাই। প্রথম উপন্যাস ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এখন কী করা যায়? আমি বাবার অফিসের ফাইলের নিচে গোপনে রেখে চলে এলাম। বাবা ফাইল দেখতে দেখতে পাণ্ডুলিপি পেয়ে যাবেন। এবং অবশ্যই আগ্রহ নিয়ে পড়বেন।
বাবার অফিস ছিল আমাদের বাসারই একটা কামরা। ফাইলপত্রে ঠাসা একটা ঘর। বাবার মাথার ওপর বিশাল এক টানা পখি। রশিদ নামের একজন ছিল সরকারি পাংখাপুলার। তার কাজ মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় যন্ত্রের মতো পাখার দড়ি টেনে যাওয়া। অয়োময় নাটক লেখার সময় আমি একটি পাংখাপুলারের চরিত্র এনেছিলাম। বাবার পাংখীপুলার রশিদের প্রচ্ছন্ন ছায়া হয়তো তার মধ্যে ছিল।
আমি রশিদকে গোপনে বলে এলাম, যদি দেখো বাবা ফাইল বাদ দিয়ে নীল রঙের একটা খাতা পড়তে শুরু করেছেন তাহলে আমাকে খুবর দেবে। রশিদ দাঁত বের করে বলল, নিশ্চিন্ত থাকেন।
টেনশান নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি। রশিদ কোনো খবর দিচ্ছে না। দুপুরে খাবার সময় বাবাকে ভেতরে এসে খেতে বলা হলো। বাবা বললেন, দেরি হবে। এই সময় রশিদ এসে আমাকে চোখ টিপ দিয়ে বলল, নীল খাতা! আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
একসময় বাবা এসে গম্ভীর ভঙ্গিতে দুপুরের খাবার শেষ করলেন। আমার লেখা বিষয়ে কোনো কথা বললেন না। সন্ধ্যাবেলা মাগরেবের নামাজ শেষ করে মা’কে ডেকে বললেন, আল্লাহপাক তোমার বড় ছেলেকে লেখক বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।