আমি আমার বড় মেয়ের বিয়েতে বিশেষ কোনো উপহার দিতে চেয়েছিলাম। শাড়ি, গয়না, ফ্রিজ, টিভির বাইরে কিছু। কী দেয়া যায় কী দেয়া যায়? নোভার অতি প্রিয় লেখকের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নোভার বিয়ের আসরে তার প্রিয় লেখককে উপস্থিত করলে কেমন হয়? এই উপহারটি হয়তো তার পছন্দ হবে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে নিমন্ত্রণ জানালাম। তাদের বললাম, মেয়ের বিয়েতে gift হিসেবে তাদের প্রয়োজন। আমাকে অবাক করে দিয়ে দুজনেই চলে এলেন। এয়ারপোর্টে থেকে সরাসরি বিয়ের আসর বিডিআর-এর দরবার হলে উপস্থিত হলেন। নোভা তার বরকে নিয়ে স্টেজে বসে ছিল। বিয়ের এবং উৎসবের উত্তেজনায় সে খানিকটা দিশেহারা। আমি বললাম, মা, তোমার বিয়ের গিফট দেখে যাও। নোভা তার অতি প্রিয় লেখককে বিয়ের আসরে উপস্থিত দেখে চমকে উঠল।
পাঠক কি ধরতে পেরেছেন মানুষকে চমকে দেয়ার একটা প্রবণতা আমার মধ্যে আছে? সৃষ্টিশীল সমস্ত কর্মকাণ্ডে চমক একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। আমরা কখন চমকাই? সচরাচর ঘটে না তা ঘটতে দেখলে চমকাই।
একজন Fiction writer চমকের ব্যাপারটি কিন্তু তার মাথায় রাখেন, কেউ অবচেতনভাবে এই কাজটি করেন, আবার কেউ সচেতনভাবেই করেন। যেমন জর্জ বার্নাড শ। লেখালেখির সময় সচেতন এবং অবচেতনভাবে অনেক কিছু করতে হয় বলেই এই কর্মটি অতীব জটিল।
Writing is a dog’s life, but the only life worth living.
–Gustave Flauvert.
লেখকের জীবন হলো কুকুরের জীবন, কিন্তু এই একমাত্র
অর্থবহ জীবন। অধ্যাপনা ছেড়ে আমি একসময় কুকুরের জীবন বেছে নেব তা কখনো ভাবি নি। এক দুপুরের কথা। বয়স উনিশ। মন আবেগে পূর্ণ। ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়েছে। ছুটি কাটাতে বরিশালের পিরোজপুরে গিয়েছি। একগাদা chemistry বই নিয়ে গেছি। আগামীকাল থেকে পড়তে শুরু করব, এই ভেবে ভেবে সময় কাটাচ্ছি। বইয়ের পাতা খোলা হচ্ছে না। বিকালে কেমন যেন অস্থির লাগে। আমি হাঁটতে বের হই। হুলারহাটের দিকে এগুতে থাকি। প্রথমেই একটা কবরখানা পড়ে। গাছপালায় ঢাকা এমন সুন্দর একটা জায়গা। একদিন কবরখানার ভেতরে ঢুকলাম। অবাক কাণ্ড, কবরখানার ভেতর টলটলে পানির ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের পাশে শ্যাওলা ধরা এক কামরার মসজিদ ভাঙা ঘাট। ভাঙা ঘাটে অতি বৃদ্ধ একজন (সম্ভবত মসজিদের ইমাম, কবরখানার কেয়ারটেকার) আমাকে দেখে বললেন, কী চান বাবা।
আমি বললাম, কিছু চাই না।
কবরখানায় ঘুরতেছেন কেন?
বেড়াচ্ছি।
বাবা, এইটা কি কোনো বেড়ানোর জায়গা? আছরের ওয়াক্ত হয়েছে, আসেন নামাজ পড়ি।
আমি বললাম, আমার অজু নাই।
পুকুরে পানি আছে। অজু করেন।
বৃদ্ধ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। একবার ইচ্ছা করল দৌড়ে পালিয়ে যাই। কেন জানি সাহসে কুলাল না। বৃদ্ধ অজু করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে।
অজু কীভাবে করতে হয় জানেন?
জানি।
অজুর দোয়া জানেন?
জি-না।
থাক, দোয়া লাগবে না। অজু করে আসেন। একত্রে নামাজ পড়ি।
আমি অজু করলাম এবং বৃদ্ধকে নিয়ে অন্ধকার মসজিদে ঢুকলাম। আসরের নামাজের দোয়া মনে মনে পড়তে হয়। বৃদ্ধ কিন্তু শব্দ করে পড়ছেন। সূরা ফাতিহার পর তিনি অতি দীর্ঘ একটা সূরা পাঠ করতে শুরু করলেন। ভয়ে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। দ্রুত অন্ধকার নামছে। চারদিকে কবর। পুকুরের পানিতে কেউ সাঁতরাচ্ছে এমন শব্দ হচ্ছে। নামাজের শেষে তিনি দীর্ঘ দোয়ায় বসলেন। এই দোয়া কোনোদিন শেষ হবে আমার এরকম মনে হলো না। নামাজে সালাম ফেরানোর একটা ব্যাপার আছে। একবার ডানে একবার বামে সালাম দিতে হয়। এই অতি বৃদ্ধ মাওলানা দোয়ার মধ্যেও কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিয়ে সালাম ফেরাচ্ছেন। পাগল না তো?
ঠিক মাগরেবের আগে আগে বৃদ্ধ দোয়া শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যান বাড়িত যান।
আমি বললাম, আপনি একা একা এখানে থাকেন?
হুঁ।
একাই নামাজ পড়েন?
বৃদ্ধ বললেন, একাই নামাজ পড়ি। তবে মাগরেব এবং এশার ওয়াক্তে অনেক জিন আমার সঙ্গে নামাজ পড়ে। সূরা পাঠে ভুল করলে তারা লোকমা দেয়।
আমি দ্রুত বের হয়ে এলাম। মাগরেবের ওয়াক্তের বাকি নাই। জিনরা সম্ভবত আসতে শুরু করেছে।
আমার বৈকালিক ভ্রমণে পিরোজপুর গোরস্থান একটি বিশেষ জায়গা দখল করে ফেলল। প্রায়ই সেখানে যাই, কবরের গায়ে লেখা নামগুলি পড়ি। বৃদ্ধ কেয়ারটেকারকে দেখি কবর পরিষ্কার করছেন। ঝোপঝাড় কাটছেন। তিনি আর কখনো আমাকে নামাজ পড়তে ডাকেন নি। তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা তেমন হতো না। একদিন শুধু বললেন, আপনার কোনো আত্মীয়স্বজন কি এখানে আছেন।
আমি বললাম, না।
তাহলে রোজ আসেন কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। জবাব দিতে পারলাম না। বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাপাকের কোনো ইশারা আছে বইল্যাই আপনে আসেন।
জানি না কাকতালীয় ব্যাপার কি-না, মিলিটারির হাতে নিহত আমার বাবার কবর হয় এই পিরোজপুরের গোরস্থানেই।
কবরস্থান-বিষয়ক অংশটি বিস্তারিত লেখার একটা কারণ আছে। আমি একদিন কবরস্থান থেকে ফিরেই প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দিই। সন্ধ্যাবেলা আয়োজন করে Chemistry-র বই বের করে পড়তে বসি। খাতায় লেখি—The term ‘macromolecule’ was first suggested by Staudinger.