আমি বললাম, ফিজিক্স ছেড়ে এখন কি এইসব পড়ছেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি ঠিক করেছি ছবি বানানোকেই আমি পেশা হিসেবে নেব।
এই বিষয়ে তো আপনি কিছুই জানেন না।
কুবরিকও কিছু জানতেন না।
কুবরিক কে?
স্ট্যানলি কুবরিক একজন ফিল্ম মেকার, সত্যজিৎ রায় যার একটা ছবি কুড়িবার দেখেছিলেন।
আপনি তার কোনো ছবি দেখেছেন?
একটাই দেখেছি ‘স্পেস অডিসি ২০০১’। অসাধারণ ছবি।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপনি তাহলে স্ট্যানলি কুবরিক হতে যাচ্ছেন?
আনিস ভাই বিরক্ত মুখে বললেন, আমাকে নিয়ে রসিকতা করবে না। আমি যা বলছি তা করব। অসাধারণ সব ছবি বানাব। এই দেশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে আমার ছবি দেখবে।
ছবি বানাতে প্রচুর টাকা লাগে। আপনি টাকা পাবেন কোথায়?
যেখান থেকেই পাই, তোমার কাছে ধার করার জন্যে যাব না।
আপনি রাগ করছেন কেন?
আমি তোমাকে আমার একটা স্বপ্নের কথা বলছি, তুমি হেলাফেলা করে শুনছ, সেইজন্যেই রাগ করছি। মানুষের স্বপ্ন নিয়ে হেলাফেলা করতে নেই।
আর করব না, সরি।
আমার স্বপ্ন কি তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?
আমি বললাম, না, মোটেই হাস্যকর মনে হচ্ছে না।
আনিস ভাইকে না বললেও আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ছেলেমানুষি বলে মনে হচ্ছিল।
আনিস ভাই তার ব্যক্তিগত স্বপ্নের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করতে চাইলেন। ছবি প্রসঙ্গে যে-কোনো বই পান নিয়ে আসেন। নিজে পড়েন। আমাকে পড়তে দেন। আমি না পড়েই বলি, পড়েছি। অসাধারণ বই।
ছবি দেখতে ভালো লাগে, ছবির শুকনো থিয়োরি পড়তে ভালো লাগবে কেন? আমার লাভের মধ্যে লাভ এই হলো আমি অনেকগুলি নাম শিখলাম। ‘আইজেনস্টাইন’, ‘বেটেলশিপ পটেমকিন’, ‘অক্টোবর’, ‘গদার’, ‘ফেলিনি’, ‘বাইসাইকেল থিফ’… আমার এই অল্প বিদ্যা পরবর্তী সময়ে খুব কাজে এসেছে। অনেক আঁতেলকে ভড়কে দিতে পেরেছি। আঁতেলদের দৌড়ও ঐ নাম পর্যন্ত বলেই ব্যাপার ধরতে পারেন নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করার পর আনিস ভাইয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আমি ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারের চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহ চলে এলাম। কাজকর্ম নেই বললেই হয়। সপ্তাহে দুটা মাত্র ক্লাস। দুপুরের পর কিছু করার নেই। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে খানিকক্ষণ হটি, রাতে গল্প লেখার চেষ্টা করি। থাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে। গেস্ট হাউস বেশির ভাগ সময় থাকে খালি। গেস্ট বলতে আমি একা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে বিচিত্র সব ভৌতিক শব্দ হতে থাকে। ভয়ে জেগে বসে থাকি। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। এই সময় আনিস ভাই মোটা এক খাতী হাতে ময়মনসিংহে উপস্থিত হলেন। তিনি একটি চিত্রনাট্য লিখে ফেলেছেন। মোটা খাতায় সেই চিত্রনাট্য। জনাব আহমেদ ছফার লেখা ওংকার উপন্যাসের চিত্রনাট্য। আমাকে শোনাবেন। আমি বললাম, কতদিন থাকবেন?
চিত্রনাট্য পড়তে যতদিন লাগে ততদিন থাকব।
চিত্রনাট্য পড়তে তার দীর্ঘদিন লাগল। একসঙ্গে তাকে বেশি পড়তে দেই না। দু’এক পাতা পড়া হতেই বলি, বন্ধ করুন। চট করে শেষ করলে হবে না। ধীরে সুস্থে এগুতে হবে। আবার গোড়া থেকে পড়ুন।
আমার ভয়, পড়া শেষ হলেই তিনি চলে যাবেন, আমি আবার একলা হয়ে যাব। একসময় চিত্রনাট্য পড়া শেষ হলো। আমাকে স্বীকার করতে হলে, অসাধারণ কাজ হয়েছে। আনিস ভাই টাকায় যাবার প্রস্তুতি নিলেন।
রাতের ট্রেনে ঢাকা যাবেন। আমি স্টেশনে তাঁকে উঠিয়ে দিতে যাব। ট্রেন রাত দশটায়, আনিস ভাই সন্ধ্যা থেকেই মনমরা। কী একটা বলতে গিয়েও বলছেন না। শুধু বললেন, খুব একটা জরুরি কথা আছে, এখন বলব না। ট্রেন ছাড়ার আগে আগে বলব।
জরুরি কথা কী হতে পারে আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। দুঃশ্চিন্তা বোধ করছি। আনিস ভাই ট্রেন ছাড়ার আগে আগে জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললেন, হুমায়ুন, আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কানাডায় যাচ্ছি ইমিগ্রেশন নিয়ে। তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন যাচ্ছেন?
আনিস ভাই সেই কেন’র জবাব দিলেন না। আমি বললাম, কবে যাচ্ছেন?
পরশু যাব। দেশের শেষ ক’টা দিন তোমার সঙ্গে কাটিয়ে গেলাম।
আমরা ছবি বানাব না?
আনিস ভাই জবাব দিতে পারলেন না, ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি খুব অভিমানী। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখলাম না। যে দেশ নিয়ে তাঁর এত। স্বপ্ন সেই দেশ ছেড়ে কী করে তিনি চলে যান? পিএইচডি করতে আমেরিকা গিয়েছি। হাতের কাছে কানাডা, ইচ্ছে করলেই ভার কাছে যেতে পারি। গেলাম না। আমার অভিমান ভালোবাসার মতোই তীব্র।
তার সঙ্গে দেখা হলো দশ বছর পর। এক দুপুরে হঠাৎ আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় এসে উপস্থিত। সমস্ত রাগ, অভিমান ভুলে ভাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কত গল্প। গল্প ফুরাতেই চায় না। একসময় ছবি বানানোর প্রসঙ্গ এসে পড়ল। তিনি জানালেন, একটা শর্ট ফিল্ম বানিয়ে হাত পাকিয়েছেন। ছবিটি জার্মান ফিলা ফ্যাস্টিভেলে ‘অনারেবল মেনসান’ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মন মোর মেঘের সঙ্গী গানের চিত্ররূপ দিয়েও একটা ছবি বানিয়েছেন ১৬ মিলিমিটারে। ছবি বানানোর টাকা এখন তার হয়েছে। দেশে এসে ছবি বানাবেন। অসুস্থ মাকে দেখতে এক সপ্তাহের জন্যে দেশে এসেছিলেন, এক সপ্তাহ কাটিয়ে কানাডা ফিরে গেলেন।
আবার যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেল। চিঠি লিখি, উত্তর আসে না। একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গিয়েছিলেন, টেলিফোন করলে নো রিপ্লাই আসে।