দাদাজানের প্রার্থনার কারণেই কিনা কে জানে তিনি সিলেট থাকতে থাকতেই বাবা বদলি হয়ে গেলেন দিনাজপুরের জগদ্দল নামের এক জঙ্গলে। সিনেমা টিনেমা সব ধুয়ে মুছে গেল। তবে তাতে আমার তেমন ক্ষতি হলো না। জগদ্দলের অপূর্ব বনভূমি আমার শিশুচিত্ত দখল করে নিল।
দাদাজানের প্রার্থনার জোর আট বছরের মাথায় কমে গেল বলে আমার ধারণা। কারণ আট বছরের মাথায় আবার সিনেমা ব্যাধি আমাকে গ্রাস করল। তখন মেট্রিক পাশ করে ঢাকায় পড়তে এসেছি। হোস্টেলে থাকি। বাবা-মা থাকেন। বগুড়ায়। পূর্ণ স্বাধীনতা। বড় হয়ে গেছি এরকম একটা ভাবও মনে আছে। আচার-আচরণে বড় হওয়াটা দেখাতে হবে। কাজেই দল বেঁধে সিনেমা দেখা। হাতের কাছে বলাকা সিনেমাহল। একটু এগুলেই গুলিস্তান। একই বিল্ডিং-এ নাজ—ভদ্রলোকের ছবিঘর। হোস্টেল সুপারের চোখ এড়িয়ে সেকেন্ড শো ছবি দেখার আনন্দও অন্যরকম। সেই সময় প্রচুর আজেবাজে ছবি দেখেছি। লাস্যময়ী নীলুর ‘খাইবার পাস’, সাপখোপের ছবি ‘নাচে নাগিন বাজে বীণ’, ‘আগ কা দরিয়া’, ‘ইনসানিয়াৎ’ (পাকিস্তানি ছবি। বম্বের ছবি না। তখন ভারতের ছবি আসত না। দেশীয় ছবি প্রটেকশন দেবার জন্যে ভারতের ছবি আনা বন্ধ ছিল)। বলাকা সিনেমাহলে নতুন ছবি রিলিজ হয়েছে আর আমি দেখি নি এমন কখনো হয় নি। এমনও হয়েছে একই দিনে দু’টা ছবি দেখেছি, দুপুর দেড়টায় ইংরেজি ছবি, তিনটায় ম্যাটিনিতে উর্দু ছবি। আমাদের সময় ছবি দেখতে টাকা লাগত কম। আইয়ুব খান সাহেব ব্যবস্থা করেছিলেন ছাত্র সিনেমা দেখবে হাফ টিকিটে। আইডি কার্ড দেখালেই অর্ধেক দামে স্টুডেন্ট টিকিট। ছাত্রদের সিনেমা দেখানোর জন্য আইয়ুব খান সাহেব এত ব্যস্ত ছিলেন কেন কে জানে। ক্রমাগত ছবি দেখে বেড়ালেও মনের গভীরে সবসময় মনে হতো—আমি যা করছি তা ঠিক না। ভুল করছি। নিজের ভেতর চাপা অপরাধবোধ কাজ করত। অবচেতন মনে হয়তো দাদাজানের বক্তৃতা খেলা করত। এই সময় একটা মজার ঘটনা ঘটল।
সুলতানা ম্যাডাম তখন আমাদের বাংলা পড়াতেন। ম্যাডাম সদ্য ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। ঝলমলে তরুণী। তখনো বিয়ে করেন নি। ছেলেদের কলেজে পড়াতে এসেছেন বলে খানিকটা ব্ৰিত। তবে চমৎকার পড়ান। আমরা ক্লাসে কোনো ফাজলামি করলে আহত চোখে তাকিয়ে থাকেন। চোখের দৃষ্টিতে বলতে চেষ্টা করেন, আমি তোমাদের এত পছন্দ করি, আর তোমরা এমন দুষ্টামি কর? আমাদের বড় মায়া লাগে। একদিন তিনি ক্লাসে এসে বললেন, আজ আমার মনটা খুব খারাপ। গতকাল একটা সিনেমা দেখে খুব কেঁদেছি। মন থেকে ছবির গল্পটা কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। সম্ভব হলে তোমরা ছবিটা দেখে। ছবির নাম ‘রোমান হলিডে।
সেই রাতেই আমরা দল বেঁধে ‘রোমান হলিডে’ দেখতে গেলাম। আমার জীবনে প্রথম দেখা ভালো ছবি। সামান্য একটা ছবি যে মানুষের হৃদয়-মন দ্রবীভূত করতে পারে, বুকের ভেতর হাহাকার তৈরি করতে পারে আমার ধারণীর ভেতর তা ছিল না। সত্যিকার অর্থে সেদিনই ছবির প্রতি পুরোপুরি আকৃষ্ট হলাম। আরম্ভ হলো বেছে বেছে ছবি দেখার পর্ব! একটা ভালো বই যেমন কয়েকবার পড়া। হয়, একটা ভালো ছবিও অনেকবার করে দেখতে শুরু করলাম। সবচেয়ে বেশি কোন ছবিটি দেখেছি? সম্ভবত ‘দি ক্রেইন আর ফ্লাইয়িং’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী। মেয়েটির প্রেমিকা যুদ্ধে গিয়েছে। মেয়েটি জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ট্রেনে করে ফিরছে সৈনিকরা, মেয়েটি ফুল হাতে এসেছে স্টেশনে। কতজন ফিরেছে, শুধু ফেরে নি সেই ছেলেটি একসময় মেয়েটি হাতের ফুল, যারা ফিরেছে তাদের হাতেই একটা একটা করে দিতে শুরু করল। তার চোখভর্তি জল। হঠাৎ সে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে ঝক ঝক বক পাখি। শীত শেষ হয়েছে বলে তারা ফিরে আসছে নিজবাসভূমে। আহা কী দৃশ্য!
আজ আমি মনে করতে পারছি না অসাধারণ সব ছবি দেখতে দেখতে কখনো মনের কোণে উঁকি মেরেছে কি-না—আহা, এরকম একটা ছবি যদি বানাতে পারতাম! অপূর্ব সব উপন্যাস পড়ার সময় এ ধরনের অনুভূতি আমার সবসময়। হয়। পথের পাঁচালী যতবার পড়ি ততবারই মনে হয়, আহা, এরকম একটা উপন্যাস যদি লিখতে পারতাম! ছবির ক্ষেত্রে এরকম না হবারই কথা। ছবি অনেক দূরের জগৎ, অসম্ভবের জগৎ, তারপরেও হতে পারে। মানুষের অবচেতন মন অসম্ভবের জগৎ নিয়ে কাজ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষের দিকে এসে অসম্ভবের জগতের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হলো, তার নাম আনিস সাবেত। পদার্থবিদ্যার তুখোড় ছাত্র, কিন্তু তার ভালোবাসা বস্তুজগতের জন্যে নয়। তার ভালোবাসা অন্য এক জগতের জন্যে। সেই জগৎ ধরাছোঁয়ার বাইরের জগৎ, আলো ও আঁধারের রহস্যময় জগৎ।
এক জোছনা রাতে রাস্তায় হাঁটছি। তিনি হঠাৎ বললেন, ফিল্মে জোছনা কীভাবে তৈরি করা হয় জানো?
আমি মাথা নাড়লাম জানি না। জানার কোনো প্রয়োজনও কখনো মনে করি নি। তিনি দেখি দীর্ঘ এক বক্তৃতা শুরু করলেন। জোছনার বক্তৃতা শেষ হবার পর। শুরু হলো জোনাকি পোকার বক্তৃত। সত্যজিৎ রায় কীভাবে জোনাকি পোকার আলো পর্দায় নিয়ে এসেছেন সেই গল্প। চার-পাঁচটা টর্চ লাইট নিয়ে কয়েকজন বসেছে। টর্চ লাইটগুলির মুখে কাপড় বাধা। তারা টর্চ জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে।