অনেক চেষ্টা করেও পিসাব হলো না। এদিকে দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়ে গেছে। মামা বিরক্ত মুখে বললেন, চল যাই।
আমাকে বসিয়ে দেয়া হলো চেয়ারের হাতলে। হল অন্ধকার হয়ে গেল। ছবি শুরু হলো। বিরাট পর্দায় বড় বড় মুখ। শব্দ হচ্ছে, গান হচ্ছে, তলোয়ারের যুদ্ধ হচ্ছে। কী হচ্ছে আমি কিছুই বুঝছি না। তবে মজাদার কিছু যে হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি। বড়মামা একেকবার হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে হলের সব লোকও হাসছে। আমি বললাম, মামী, কী হচ্ছে?
মামা বললেন, চুপ। কথা বললে থাবড়া খাবি।
আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললাম, মামা, পিসাব করব।
মামা করুণ ও হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একটু পর পর বলতে লাগলাম, মামা, আমি পিসাব করব। মামা, আমি পিসাব করব। সম্ভবত তখন ছবির কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছিল। মামা পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, নিচে নেমে পিসাব করে ফেল। কিছু হবে না।
আমি তৎক্ষণাৎ মাতুল আজ্ঞা পালন করলাম। সামনের সিটের ভদ্রলোক মাথা ঘুরিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, এই ছেলে তো প্রস্রাব করছে! আমার পা ভিজিয়ে ফেলেছে।
মামা বললেন, ছেলেমানুষ প্রস্রাব তো করবেই। আপনার ঘরে ছেলেপুলে নেই? পা তুলে বসুন না।
সেই সময়ের মানুষদের সহনশীলতা অনেক বেশি ছিল। ভদ্রলোক আর কিছুই বললেন না। পা তুলে মনের আনন্দে ছবি দেখতে লাগলেন।
আমার প্রথম ছবি দেখার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর না হলেও খারাপও ছিল না। অন্ধকার হল, পর্দায় ছবির নড়াচড়া আমার ভালোই লাগল। ইন্টারভ্যালের সময় বাদাম এবং কাঠি লজেন্স খাওয়ার একটা ব্যাপারও আছে। বাসা থেকে রিকশায় করে হলে যাওয়া এবং ফেরার মধ্যেও আনন্দ আছে, রিকশায় চড়ার আনন্দ। কাজেই ছবি দেখার কোনো নড়াচড়া পেলেই আমি এমন কান্নাকাটি, হৈচৈ শুরু করে দেই যে আমাকে না নেয়া ছাড়া কোনো পথ থাকে না।
সিলেটে আমাদের বাসায় মেহমান লেগেই থাকতো। শাহজালাল সাহেবের দরগা জিয়ারতের মেহমান। তারা প্রথম দিন শাহজালাল সাহেবের দরগায় যেতেন (আমি সঙ্গে আছি, দরগীর গেটে হালুয়া কেনা হবে। যার স্বাদ ও গন্ধ বেহেশতি হালুয়ার কাছাকাছি)। শাহজালাল সাহেবের মাজার জিয়ারতের পর আসে শাহ পরাণ সাহেবের মাজার জিয়ারতের প্রশ্ন। অধিকাংশ মেহমান সেই মাজার এড়িয়ে যান। গরম মাজার, ভুল ত্রুটি হলে মুশকিল। মাজারপর্ব শেষ হবার পর মেহমানদের ছবি দেখার আগ্রহ জেগে ওঠে। সিলেটে শহরে তখন দুটি ছবিঘর। দুই ছবিঘরে দু’রাত ছবি দেখা হয়। আমি তখনো সঙ্গে আছি।
সবচেয়ে মজা হতো মার সঙ্গে ছবি দেখতে গেলে। পুরনো শাড়ি দিয়ে রিকশা পেঁচানো হতো। বোরকা পরা মায়েরা রিকশার ঘেরাটোপে ঢুকে যেতেন। আমরা বাচ্চারা পর্দার বাইরে। এক-একজন মহিলার সঙ্গে চার-পাঁচটা করে শিশু। দুটি সন্তানই যথেষ্ট এই থিয়োরি তখনো চালু হয় নি। সেসময় দুটি সন্তান যথেষ্ট নয় বলে বিবেচনা করা হতো।
সিনেমা হলে মহিলাদের বসার জায়গা আলাদা। কালো পর্দা দিয়ে ছেলেদের কাছ থেকে আলাদা করা। ছবি শুরু হবার পর পর্দা সরানো হবে। তার আগে নয়। মহিলাদের অংশে খাণ্ডারনী টাইপের একজন আয়া থাকে। তার কাজ হলো, ছবি শুরু হবার পর সামনের কোনো পুরুষমানুষ পেছনদিকে তাকাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ রাখী। কেউ তাকালেই বিকট চিৎকার—ঐ কী দেখস? চউখ গালাইয়া দিমু। ঘরে মা ভইন নাই?
পর্দায় উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক সংলাপ হচ্ছে আর এদিকে চলছে শিশুদের চেঁ ঊ্যা। মায়েদের তাতে ছবি উপভোগ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এই শিশুকে সামলাচ্ছেন, এই সুচিত্রার কষ্টে চোখের পানি ফেলছেন। সাধে কি আর বলে, মেয়েরা সর্বংসহা।
সেবছরই শীতের শুরুতে হঠাৎ বাসায় সাজ সাজ রব পড়ে গেল। দেয়ালের ছবি সব নামিয়ে ফেলা হতে লাগল। বাসায় যে ফরসি হুঁকা আছে তা ঘষেমেজে পরিষ্কার করা হতে লাগল। দেশ থেকে দাদাজান আসবেন। আমি খুব উল্লসিত বোধ করলাম না। কারণ দাদাজান নিতান্তই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। ইবাদত বন্দেগি নিয়ে থাকেন। মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন বলেই বোধহয় আমাদের সবসময় পড়া ধরেন। সন্ধ্যাবেলা নামাজ শেষ করেই বলবেন, কই বই নিয়ে সবাই আস দেখি। পড়া না পারলে তার মুখ স্কুলের স্যারদের মতোই গম্ভীর হয়ে যায়। এরকম মানুষকে ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। গল্প যে তিনি একেবারেই বলতেন না তা না, বলতেন, তবে বেশির ভাগই শিক্ষামূলক গল্প। ‘ঈশপ’ টাইপ। সব গল্পের শেষে কিছু উপদেশ।
এক রাতের কথা, দাদাজানের সম্ভবত মাথাব্যথা? আমাদের পড়তে বসতে হলো না। বাতি নিভিয়ে তিনি শুয়ে রইলেন। আমাকে ডেকে বললেন, দেখি একটা গল্প বল তো।
আমি তৎক্ষণাৎ গল্প শুরু করলাম। সদ্য দেখা সিনেমার গল্প। কোনো কিছুই বাদ দিলাম না। সুচিত্রা-উত্তমের প্রেমের বিশদ বর্ণনা দিলাম। দাদা শুয়ে ছিলেন, এই অংশে উঠে বসলেন। তার মুখ হা হয়ে গেল। আমার ধারণা হলো, তিনি গল্প খুব পছন্দ করছেন। গল্প শেষ করে উৎসাহের সঙ্গে বললাম, আরেকটা বলব। দাদাজান?
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, না, তোর মাকে ডাক।
মা এসে সামনে দাঁড়ালেন। দাদাজান একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতায় অনেক কঠিন কঠিন তৎসম শব্দ ব্যবহার করা হলো। বক্তৃতার সামারি এন্ড সাবসটেন্স হচ্ছে—বাবা-মা’র প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য সন্তান সভাবে পালন। সেই কর্তব্যে গুরুতর অবহেলা হচ্ছে। ছেলে সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছে। গান বাজনা, নাটক-নভেল, সিনেমা সবই আত্মার জন্যে ক্ষতিকর। এই ছেলের ভয়ঙ্কর ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আর যেন না হয় সেই চেষ্টা করতে হবে। বউমা, তোমাদের সবার জন্যে সিনেমা নিষিদ্ধ। কারণ তোমাদের দেখেই তোমাদের ছেলেমেয়েরা শিখবে। যাই হোক, আমি খাস দিলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি যেন সিনেমা নামক ব্যাধির হাত থেকে তোমরা দূরে থাকতে পার।