অনুষ্ঠান চলছে। গানবাজনা হচ্ছে। আমি ছেলের পাশে চুপচাপ বসে আছি। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি—বাবা! চার-পাঁচটা বিয়ের ব্যাপারটা কী? তারপরই মনে হলো কী হবে জিজ্ঞেস করে।
এখন আমার ইচ্ছা করছে দ্বিতীয় বিয়ের কিছু খণ্ডচিত্র লিখে ফেলি। অন্য কেউ জানতে চাক না-চাক নিষাদ একসময় জানতে চাইবে।
তখন আমার খুব দুঃসময়। মানসিক বিপর্যয়। শাওনকে তার বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। তার থাকার জায়গা নেই। আমাকে আমার আত্মীয়স্বজনরা পরিত্যাগ করেছে। বন্ধুবান্ধবও পরিত্যাগ করেছে। আমি শাওনকে ডেকে বললাম, আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করছি, কিন্তু তোমার এটা প্রথম বিয়ে। অন্য মেয়েরা যেভাবে বিয়ে করে তুমি সেইভাবেই কর। টাকা দিচ্ছি, যাও একটা বিয়ের শাড়ি কিনে আন।
সে বলল, একা একা বিয়ের শাড়ি কিনে আনব?
আমি বললাম, হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথ তোমার জীবনের এই ঘটনার কথা মনে করেই লিখেছেন—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে।’
সে খুবই অল্প টাকায় একটা শাড়ি কিনে আনল। তারপর পার্লারে গেল সাজতে। আমার খুব মায়া লাগল। আজ বেচারির বিয়ে। কেউ তার পাশে নেই? একজন আত্মীয়! বা একজন বন্ধু!
আমি অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহারের স্ত্রীকে টেলিফোন করে বললাম, স্বর্ণা! একটা মেয়ে বিয়ে করছে। কেউ তার পাশে নেই। একা একা পার্লারে বসে আছে। তোমরা সবাই আমাকে ত্যাগ করেছ আমি জানি। আজকের দিনে মেয়েটার পাশে দাঁড়াও।
স্বর্ণা বলল, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
শাওন-পুত্র নিষাদ একদিন বড় হবে। সে অবশ্যই ভালোবেসে অতি রূপবতী কোনো তরুণীকে বিয়ে করবে। প্রকৃতির অমোঘ বিধানে সেই বিয়েতে আমি উপস্থিত থাকব না। তবে আমি চাই খুব ধুমধাম করে সেই বিয়ে হোক। যেন ছেলের বিয়ের আনন্দ দেখে শাওন তার নিজের আয়োজনহীন নিঃসঙ্গ বিয়ের স্মৃতি পুরোপুরি ভুলে যায়।
২১.
হাতে কোনো বই এলে আমি সবার আগে বইটির পেছনের ফ্ল্যাপে কী লেখা তা পড়ি। সেখানে লেখকের গম্ভীর মুখের একটা ছবি থাকে। তার জন্মবৃত্তান্ত এবং লেখালেখির ইতিহাস থাকে। বেশির ভাগ সময় লেখক নিজেই এই লেখাটা লেখেন বলে তিনি নিজের সম্পর্কে কী ভাবেন তা জানা যায়। একজন লেখক নিজের সম্পর্ক লিখছেন—
তাঁর লেখায় মানবজীবনের শত বঞ্চনা ভৈরবী রাগিনীর মতো মৃঞ্ছিত হয়েছে। তিনি লাঞ্ছিত নিপীড়িতের মহান আলেখ্যকার। তার দশটি অসাধারণ গল্পের সংকলন দশ পথিকের পাঁচালি (প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়েছে, দ্বিতীয় মুদ্রণের কাজ চলছে।) ইংরেজি অনুবাদ করছেন শেখ নজরুল ইসলাম এম এ (ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য)। গল্পগ্রন্থের ইংরেজি নাম Ten Lost Soules Story.
লেখক পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। তার ছোটভাই বাংলাদেশ সরকারের একজন কীর্তিমান নির্ভীক ম্যাজিস্ট্রেট। এক বোন ইতিহাসের প্রভাষক। ভাগ্নিজামাই ছদরুল হোসেন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং সমাজসেবক।
পাঠক, আবার ভাবছেন না তো আমি এদের নিয়ে তামাশা করছি! তামাশা করার প্রশ্নই আসে না। আমার অনেক বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা আমি নিজে লিখেছি। এখনো লিখছি। নিজেকে পণ্যের আকারে প্রকাশ করার কিছু মজা অবশ্যই আছে।
সবকিছু বদলায়। ফ্ল্যাপের লেখাও বদলায়। শুরুর দিকে মোট কয়টি বই লিখেছি এইসব তথ্য থাকত। কিছু পুরস্কার পাবার পর পুরস্কার তালিকা চলে এল। কিছুদিন পর লেখা হতে লাগল–তিনি টিভিতে ধারাবাহিক নাটক লেখেন। এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়ময়’, ‘বহুব্রীহি তার লেখা নাটক। এরপর চলে এল ছবি। তিনি ছবি বানান। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘আগুনের পরশমণি’।
ছবির বিষয়ে কিছুই জানি না। ক্যামেরা জানি না। শট কী বুঝি না। ‘ইন’ ‘আউট’ নামক জটিলতা জানি না, তারপরেও কেন ছবি বানাতে গেলাম? ছবি বানানোর গল্প নামের একটি বইয়ে আমি তা ব্যাখ্যা করেছি। বই থেকে এই অংশ পুনর্মুদ্রিত করছি, কারণ বলপয়েন্টে এই লেখা থাকা দরকার—
.
আমার প্রথম দেখা ছবির নাম ‘বহুত দিন হোয়ে’। খুব যে আনন্দময় অভিজ্ঞতা তা না। আমার শিশুজীবনের খানিকটা গ্লানি ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বড় মামার সঙ্গে ছবি দেখতে গিয়েছি। মামা নিতান্তই অনাগ্রহের সঙ্গে আমাকে নিচ্ছেন। তার ধারণা বাতি নেভার সঙ্গে সঙ্গে আমি কাঁদতে শুরু করব। মাঝখান থেকে তাঁর ছবি। দেখা হবে না। আমি যে কাঁদব না তা মামাকে নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছি। মামা বুঝছেন না।
কাঁদলে কিন্তু আছাড় দিয়ে ভুড়ি গালিয়ে ফেলব।
কাঁদব না মামা।
পিসাব পায়খানা যা করার করে নাও। ছবি শুরু হবে আর বলবে পিসাব তা হবে না।
আচ্ছা।
কোলে বসে থাকবে, নড়াচড়া করবে না। নড়লে চড় খাবে।
নড়ব না।
এতসব প্রতিজ্ঞার পরেও মামা বিমর্ষ মুখে আমাকে নিয়ে রওনা হলেন। সিলেটের ‘রঙমহল’ সিনেমায় ছবি দেখতে গেলাম। গেটে দুটা সিংহের মূর্তি। দেখেই গা ছমছম করে। মনে হয় গেটের ওপাশে না জানি কত রহস্য।
মামা টিকিট কিনলেন। সেসময় লাইন-টাইনের কোনো ব্যাপার ছিল না। মনে হয় এখনো নেই। ধস্তাধস্তি করে টিকিট কাটতে হতো। টিকিট হাতে ফিরে। আসা আর যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসা কাছাকাছি ছিল। বাচ্চাদের কোনো টিকিট লাগত না। তারা কোলে বসে দেখতো কিংবা চেয়ারের হাতলে বসে দেখতে।
ছবি শুরু হতে দেরি আছে। মামা চা কিনলেন। আমার জন্যে দু’পয়সার বাদাম এবং চানাজা কেনা হলো। মামা বললেন, এখন না। ছবি শুরু হলে খাবে। আমি ছবি শুরুর জন্যে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। চারদিকে লোকজন, হৈচৈ কোলাহলে নেশার মতো লাগছে। বুক ধক্ ধক্ করছে না জানি কী দেখব। ছবি শুরুর প্রথম ঘণ্টা পড়ল। সেই ঘণ্টাও অন্যরকম। বেজেই যাচ্ছে, থামছে না। লোকজন হলে ঢুকতে শুরু করেছে মামা ঢুকলেন না। আমাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, পিসাব কর। ছবি শুরু হবে, আর বলবে পিসাব—তাহলে কান ছিঁড়ে ফেলব। (প্রিয় পাঠক, মামা অন্যকিছু ছেঁড়ার কথা বলেছিলেন। সুরুচির কারণে তা উল্লেখ করছি না।)