পল তার নোটবই বের করে কদম ফুলের নাম লিখে নিল। আমি সেখানে রবীন্দ্রনাথের গানের চারটি চরণও লিখে দিলাম।
তুমি যদি দেখা না দাও
করো আমায় হেলা
কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল বেলা।
(If thou showest me not thy face,
If thou leavest me wholly aside,
I know not how i am to pass
These long rainy hours.)
পল অরসনের সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। তবে ঘোর বর্ষার সময় আমি যখন রাস্তায় থাকি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকাই, যদি রিকশার হুড় ফেলা অবস্থায় ভিজতে ভিজতে কোনো সাহেবকে যেতে দেখা যায়।
২০.
কিছুদিন আগে ষাট বছর পূর্ণ করলাম। এটা কোনো সুসংবাদ না, ভয়াবহ দুঃসংবাদ। দিন শেষ হয়ে আসছে। মহাযাত্রার সময় আগত। ট্রেনের চাকার শব্দ কানে আসছে।
কিছু কিছু দুঃসংবাদকে সুসংবাদ ভেবে পালন করার রেয়াজ আমাদের আছে। ৫০তম জন্মদিন, ৬০তম জন্মদিন পালন সেরকম ব্যাপার। শুনলাম জন্মদিন পালনে বিরাট প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সারাদিনব্যাপী হুমায়ূন মেলা, জলসা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এইসব। আমি একটা ব্যাপারে খুশি, উৎসব হাতছাড়া হয়ে যায় নি। হাতছাড়া হবার উপক্রম হয়েছিল। ঘটনাটা বলি।
মাসুদ আখন্দ নামে এক যুবক থাকে সুইডেনে। সে নাকি তার জীবনের চরম দুঃসময়ে আমার বই পড়ে বেঁচে থাকার সাহস, প্রেরণা এবং আনন্দ পেয়েছিল। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সেই বইপড়া ঋণ শোধ করার তাগিদ বোধ করল। সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে এল ঢাকায়। বাকি জীবন নাকি সে গুরুর (হুমায়ুন আহমেদ) সেবা করে কাটিয়ে দেবে। অতি বৃদ্ধ বয়সে যখন একা একা বাথরুমে যাবার মতো শক্তি থাকবে না, তখন সে আমাকে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যাবে। বাথরুম থেকে নিয়ে আসবে।
আমার ষাটতম জন্মদিন নিয়ে সে বিরাট লাফ-ঝাঁপ শুরু করল। এর সঙ্গে মিটিং তার সঙ্গে মিটিং। তার পরিকল্পনাও ভয়াবহ। ঐ দিন বাংলাদেশের সমস্ত হিমুদের চাকায় ডাকা হবে। তারা সারাদিন একটী স্টেডিয়ামে র্যালি করবে। তাদের নাম রেজিস্ট্রেশন হবে। তাদের জন্যে হবে কনসার্ট। হিমু কনসার্ট। সব শেষে আমি হিমুদের উদ্দেশে ভাষণ দেব।
আল্লাহপাকের আমার ওপর বিশেষ করুণা আছেই বলেই ঘটনা শেষ পর্যন্ত স্টেডিয়ামে গেল না। পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে সীমাবদ্ধ রইল।
আমার মা ভোরবেলায় ষাটটা বেলুন উড়িয়ে পুত্রের শুভ জন্মদিন ঘোষণা করলেন। ছোট্ট একটা ভাষণও তিনি দিলেন। ভাষণের সারমর্ম তার ছেলেকে ঘিরে যে এত আনন্দ উল্লাস হবে তা তিনি সবই জানতেন। ইত্যাদি।
সন্ধ্যার পর মূল অনুষ্ঠান। আমি গম্ভীর মুখ করে স্টেজে বসে আছি। ইমদাদুল হক মিলন মাইকে বলে যাচ্ছে—
এখন অমুক এসেছেন, লেখককে ফুলের তোড়া উপহার দিলেন।
এখন এসেছেন অমুক। তিনি লেখককে…
কয়েকটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের ব্যাপার ছিল। বইগুলির প্রকাশকরা মোড়ক উন্মোচনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ লোক খুঁজছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের একটি তালিকাও প্রস্তুত হয়েছিল। আমি প্রকাশকদের বললাম, আমার কাছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকজন হচ্ছে আমার পরিবারের লোকজন। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন তারাই করবে।
আমার কনিষ্ঠপুত্র নিষাদ (বয়স এক বছর নয় মাস) একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে গম্ভীর হয়ে গেল। বইয়ের কভারে তার বাবার ছবি দেখে মহানন্দে বলতে লাগল—এইটা বাবা!
বড় পুত্র নুহাশ একটি বইয়ের মোড়ক খুলল।
স্ত্রী শাওন একটি। আমি একটি পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ আর কেউ নেই। অথচ একটি বইয়ের মোড়ক তখনো খোলা হয় নি। আমি মিলনকে ডাকলাম। একজন লেখক সবসময়ই আরেকজন লেখকের অতি ঘনিষ্ঠজন। পরিবারের সদস্য না হয়েও সদস্য।
শুরু হলো বক্তৃতামালা। আমি বক্তৃতাগুলি আগ্রহ নিয়ে শুনছি, কারণ আজ যারা বক্তৃতা দিচ্ছেন তারাই আমার মৃত্যুর পরের শোকসভায় বক্তৃতা দেবেন। তারা আজ যা বলছেন, মৃত্যুর পরের সভায় তাই বলবেন। নতুন কিছু না।
বক্তাদের মধ্যে রাশিয়ান ছেলে পাভেলের বক্তৃতা শুনে আনন্দ পেলাম। দর্শকরাও তুমুল হাততালি দিল। পাভেল আমার একটি উপন্যাস (সবাই গেছে বনে) রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছে। সে বক্তৃতা দিল বাংলায়।
আমার জন্যে বড় ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ ইমদাদুল হক মিলন ঘোষণা করলেন, হুমায়ূন আহমেদের বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূন তার বাবার সম্পর্কে কিছু বলবে। নুহাশ হুমায়ূন তার বাবার একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছে। বইটির নাম ফিহা সমীকরণ।
দর্শকদের মতো আমিও আগ্রহ নিয়ে ছেলের দিকে তাকালাম। সে বলল, অনেকেই এই অনুষ্ঠানে আমার বাবার নাম ভুল উচ্চারণ করেছেন। আমার তা মোটেই ভালো লাগে নি। তাঁর নামের শুদ্ধ উচ্চারণ হওয়া উচিত। তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ। আহাম্মেদ না। আহমদ না।
পিতার নামের শুদ্ধ উচ্চারণে তার আগ্রহ দেখে মজা লাগল। তারপরেই সে যা বলল তা শুনে দর্শকরা কিছুক্ষণ হতভম্ব সময় কাটালো। তারপরই তুমুল তালি।
সে বলল, আমার বাবা যখন খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন তখন তার পাশে আমি উপস্থিত থাকতে পারি নি। তিনি যখন চার-পাঁচটা বিয়ে করেন তখনো আমি ছিলাম অনুপস্থিত। আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে ভালো লাগছে।
আমার মাথার ভেতর সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। ছেলে এইসব কী বলছে? আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। চার-পাঁচটা করি নি। আজকের অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বিয়ে টেনে আনাও অশোভন। সে সেখানে চার-পাঁচটা বিয়ে কোথায় পেল?