বৃষ্টি নিয়ে আমার মজার কিছু স্মৃতি আছে। যেমন, এক আষাঢ় মাসে আমি রওনা হলাম কক্সবাজার। ঝুম বৃষ্টিতে সমুদ্রের পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকব। দেখব কেমন লাগে।
তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। আমি গলাপানিতে বসে আছি। ঢেউ এসে মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এমন আনন্দময় অভিজ্ঞতা বহুদিন হয় নি। পাঠকদের কাছে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, আমি সাগরে নেমেছিলাম সকাল দশটায়। উঠে আসি সন্ধ্যা মেলাবার পর। দুপুরের লাঞ্চ ছিল একটা ডাবের পানি এবং শাঁস।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর না। আমার পুত্র নুহাশের বয়স তখন চার মাস। আমি থাকি শহীদুল্লাহ হলে। নামল তুমুল বৃষ্টি। নুহাশের মা বাসায় নেই। ছেলেকে বৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার এই সুযোগ। আমি তাকে নিয়ে ছাদে চলে এলাম। পিতা-পুত্রের ওপর ধারাবর্ষণ হচ্ছে। পুত্র খুবই মজা হচ্ছে। হলের ছাত্ররাও মজা পাচ্ছে।
আমার মজা স্থায়ী হয় নি, কারণ ঠান্ডা লেগে নুহাশের নিউমোনিয়া হয়ে গেল। ডাক্তার-হাসপাতাল ছোটাছুটি। পুত্রের মাতার অবর্ষণ।
বর্ষাযাপন নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা লিখেছি। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা যক্ষের ধনের মতো সঞ্চয় করে রাখার অভ্যাস আমার নেই বলে লেখাগুলি হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে একটা লেখা ছিল আমেরিকায় বর্ষাযাপনের অভিজ্ঞতা। মন্টানার বনভূমিতে প্রবল বৃষ্টির গল্প।
বাংলার প্রিয় কবি জীবনান্দ দাশের মধ্যে বর্ষা নিয়ে মাতামাতি দেখি না। তিনি হেমন্ত এবং কুয়াশা নিয়েই স্বস্তি বোধ করেছেন। উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। বর্ষার পুরো অভিজ্ঞতা তিনি নিয়ে এসেছেন একটি কবিতায়, কবিতার নাম ‘বর্ষা যাপন’।
বাড়িছে বৃষ্টির বেগ থেকে থেকে ডাকে মেঘ
ঝিল্লীরব পৃথিবী ব্যাপিয়া
এমন ঘন ঘোর নিশি দিবসে জাগরণে মিশি
না জানি কেমন করে হিয়া
বৃষ্টিকে রবীন্দ্রনাথের মতো আপন করে কেউ অনুভব করেছেন বলে আমি মনে করি না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে আমি ছোট্ট একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল এখন মনে করতে পারছি না। পাঠকদের জন্যে লেখাটি আবারো দিয়ে দিলাম। বিচিত্র কারণে এই লেখাটি বেশ কিছু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। (ইংরেজি অনুবাদ কী একটা সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে।)
বর্ষা যাপন
কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকা শহরের এক কমুনিটি সেন্টারে বিয়ে খেতে গিয়েছি। চমৎকার ব্যবস্থা। অতিথির সংখ্যা কম। প্রচুর আয়োজন। থালা বাসনগুলি পরিচ্ছন্ন। যারা পোলাও খাবেন না, তাদের জন্যে সরু চালের ভাতের ব্যবস্থা। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে দেখলাম বেশকিছু বিদেশী মানুষও আছেন। তাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী। দেখার মতো কোনো অনুষ্ঠান নেই বলে কন্যা কর্তা খানিকটা বিব্রত। এটা শুধুমাত্র খাওয়ার অনুষ্ঠান তা বলতে বোধহয় কন্যা কর্তার খারাপ লাগছে। বিদেশীরা যতবারই জানতে চাচ্ছে, মূল অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে? ততবারই তাদের বলা হচ্ছে, হবে হবে।
কোণার দিকের একটা ফাঁকা টেবিলে খেতে বসেছি। আমার পাশের চেয়ারে এক বিদেশী ভদ্রলোক এসে বসলেন। আমার কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো। মেজাজ খারাপ হবার প্রধান কারণ—ইনি সঙ্গে করে কাটা চামচ নিয়ে এসেছেন। এঁদের এই আদিখ্যেতা সহ্য করা মুশকিল। কাঁটা চামচ নিশ্চয়ই এখানে আছে। সঙ্গে করে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল না। আমি আগেও লক্ষ করেছি, যারা কাঁটা চামচ দিয়ে খায় তারা হাতে যারা খায় তাদের বর্বর গণ্য করে। যেন সভ্য জাতির একমাত্র লোগো হলো কাঁটা চামচ। পাশের বিদেশী তাঁর পরিচয় দিলেন। নাম পল অরসন। নিবাস নিউমেক্সিকোর লেক সিটি। কোনো এক এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশে এসেছেন অল্পদিন হলো। এখনো ঢাকার বাইরে যান। নি। বিমানের টিকিট পাওয়া গেলে সামনের সপ্তাহে কক্সবাজার যাবেন।
কিছু জিজ্ঞেস না করলে অভদ্রতা হয় বলেই বললাম, বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
পল অরসন চোখ বড় বড় করে বলল, Oh, wonderful!
এদের মুখে Oh, wonderful শুনে আহ্লাদিত হবার কিছু নেই। এরা এমন বলেই থাকে। এরা যখন এদেশে আসে, তখন তাদের বলে দেয়া হয়, নরকের মতো একটা জায়গায় যাচ্ছ। প্রচণ্ড গরম। মশা-মাছি। কলেরা-ডায়রিয়া। মানুষগুলিও খারাপ। বেশির ভাগই চোর। যারা চোর না তারা ঘুসখোর। এরা প্রোগ্রাম করা অবস্থায় আসে, সেই প্রোগ্রাম ঠিক রেখেই বিদেয় হয়। মাঝখানে Oh wonderful জাতীয় কিছু ফাঁকা বুলি আওড়ায়।
আমি পল অরসনের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললাম, তুমি যে ওয়ান্ডারফুল বললে, গুনে খুশি হলাম। বাংলাদেশের কোন জিনিসটা তোমার কাছে ওয়ান্ডারফুল মনে হয়েছে?
পল বলল, তোমাদের বর্ষা।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। এ বলে কী! আমি আগ্রহ নিয়ে পলের দিকে তাকালাম। পল বলল, বৃষ্টি যে এত সুন্দর হতে পারে এদেশে আসার আগে আমি বুঝতে পারি নি। বৃষ্টি মনে হয় তোমাদের দেশের জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। তুমি শুনলে অবাক হবে, আমি একবার প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রিকশার হুড ফেলে মতিঝিল থেকে গুলশানে গিয়েছি। আমার রিকশাওয়ালা ভেবেছে, আমি পাগল।
আমি পলের দিকে ঝুঁকে এসে বললাম, তোমার কথা শুনে খুব ভালো লাগল। অনেক বিদেশীর অনেক সুন্দর কথা আমি শুনেছি, কিন্তু তোমার মতো সুন্দর কথা আমাকে এর আগে কেউ বলে নি। এত চমৎকার একটি কথা বলার জন্যে তোমার অপরাধ ক্ষমা করা হলো।