বাবা বাসায় ফিরে মাকে বললেন, তোমার বড় ছেলে এমন সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করেছে, ওকে পুরস্কার হিসাবে দশটা টাকা দিয়ে দাও। সংসার খরচের সব টাকা থাকে মা’র কাছে। টাকা দিতে হলে তাকেই দিতে হবে। দশ টাকা তখন অনেক টাকা। আমি দীর্ঘদিন ঘ্যানঘ্যান করার পর মা’র কাছ থেকে দু’টাকা আদায় করতে পারলাম। সেই টাকায় সঙ্গে সঙ্গে চারটা স্বপন কুমার সিরিজের বই কিনে আনলাম। প্রতিটি বইয়ের দাম আট আনা। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।
এক যুগ আগে কী একটা কাজে চিটাগাং গিয়েছি। খোঁজ নিয়ে জানলাম হরলাল রায় স্যার জীবিত। রিটায়ার করেছেন। শরীর দুর্বল। দিনরাত শুয়েই থাকেন।
ঠিকানা জোগাড় করে তাকে দেখতে গেলাম। পা স্পর্শ করে বললাম, স্যার আমি হুমায়ূন। স্যার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই হুমায়ূন না রে ব্যাটা। তুই হুমায়ূন আহমেদ। বলেই হৈচৈ শুরু করলেন, কে এসেছে দেখ। কে এসেছে দেখ। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল। মনে হলো আমার মানবজন্ম সার্থক। (আমি অকৃতী অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি। যা দিয়েছ তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাও নি। )
পৃথিবীতে কিছু ব্যাধি আছে যার ওষুধ নেই। যেমন ক্যানসার, পাঠব্যাধি। পাঠব্যাধিতে আক্রান্তজনকে কিছু-না-কিছু পড়তেই হবে। পড়ার কিছু না থাকলে মনে হবে, মরে যাই। অতি অল্পবয়সে আমি এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলাম। প্রচণ্ড পড়ার ক্ষুধা। পড়ার বই নেই। বাবার সমস্ত বই তালাবন্ধ। কারণ সবই বড়দের বই। পড়ার বয়স হয় নি।
আমাদের শৈশবে পড়ার বইয়ের বাইরের সব বইয়ের সাধারণ নাম আউটবুক। ছাত্রদের জন্যে আউট বুক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ আউট বুক দুটো কাজ করে—
সময় হরণ করে। চরিত্র হরণ করে।
.
আমরা তখন থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। আমাদের সঙ্গে এক চাচা এবং এক মামাও থাকেন। তারা সিলেট MC কলেজের ছাত্র। তাদের প্রধান কাজ প্রতি বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়া এবং ফেল করা। মাঝে মাঝে তারা গল্প উপন্যাসের বই নিয়ে আসেন এবং এমন এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখেন যে, খুঁজে বের করতে শার্লক হোমস লাগে।
একদিন খুঁজে পেয়ে গেলাম। তারা বই লুকিয়ে রাখেন বালিশের ওয়ারের ভেতর। একদিন সেখান থেকে একটা বই উদ্ধার করলাম। বইয়ের নাম দুটি বৃন্তে একই ফুল। মলাটে গাছের দুই শাখায় নয়নতারা ফুলের মতো ফুল। ফুলের ভেতরে দু’টা মেয়ের মুখ। খাটের নিচে বসে লুকিয়ে বই পড়ে ফেললাম। কাহিনী হচ্ছে, দুই বোন একই সঙ্গে এফ এ ক্লাসে পড়ছে এমন একটি ছেলের প্রেমে পড়েছে। দুটি মেয়ের চোখেই বিজলি জ্বলে। বিজলি একটা ভয়াবহ জিনিস। বিজলির পরপরই বজ্রপাত। এই বিজলি মেয়ে দুটির চোখে কেন জ্বলে কিছুই। বুঝলাম না।
এ ছাড়াও ব্যাপার আছে, মেয়ে দুটির বুকে বুনোফুল প্রস্ফুটিত হবার জন্যে অপেক্ষায়। বুকে ফুল কীভাবে ফুটবে সেটা আরেক রহস্য।
খাটের নিচে বসে আমি নিষিদ্ধ বই পড়ছি, খবরটা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। মা তালপাতার পাখা দিয়ে মেরে কঠিন শাস্তি দিলেন। আমার এই গুরুতর অপরাধ উচ্চ আদালতে (বাবার কাছে) পেশ করলেন। বাবা তার পরদিনই আমাকে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে নিয়ে গেলেন। লাইব্রেরির সদস্য করে দিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম সেই বিশাল লাইব্রেরির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। হঠাৎ প্রকাণ্ড একটা জানালা আমার সামনে খুলে গেল। জানালা দিয়ে আসা অলৌকিক আলো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
০৩.
Everyone who works in the domain of fiction is a bit crazy. The problem is to render this craziness interesting.
–Francois Truffaut.
‘সুনীল সাগর’ বাক্যটা সুন্দর। ‘স’-এর অনুপ্রাস আছে। বাক্যের দু’টা শব্দই তিন অক্ষরের বলে প্রচ্ছন্ন ছন্দের দোলা আছে। বাক্যটি সাগরের গুণ প্রকাশ করছে। ‘সুনিলিত সাগরিত’ বাক্যটায় কী বোঝাচ্ছে। সম্পূর্ণ অর্থহীন একটা বাক্য না? বছর ত্রিশ আগে আমরা ঠিক করলাম, একটা পারিবারিক দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করব। দেয়াল পত্রিকার নাম হবে ‘সুনীল সাগর’। আমি সেই নাম পাল্টে নাম দিলাম ‘সুনিলিত সাগরিত’। সম্পূর্ণ অর্থহীন নাম।
আমি প্রধান সম্পাদক। জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব ছিল পত্রিকার অঙ্গসজ্জার দায়িত্বে। পনেরো দিন পর পর ঢাউস এক কাগজে সবার লেখা ছাপা হতো। কেউ বাদ যেত না। সুনিলিত সাগরিত পত্রিকাটি আমাদের পারিবারিক ধারাবাহিক ইতিহাস। আমার নিজের লেখালেখির ইতিহাস। আমার দুই ভাইয়ের লেখালেখিরও ইতিহাস। দুই বোন সুফিয়া ও শিখুও ভালো লিখত। তারা কেন জানি এই পারিবারিক পত্রিকার বাইরে নিজেদের প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকল।
দেয়াল পত্রিকার প্রকাশনা অতি সঙ্গত কারণেই ছিল অনিয়মিত। একটা পর্যায়ে প্রকাশনা হয়ে দাঁড়াল পারিবারিক বিশেষ বিশেষ ঘটনানির্ভর। পরিবারের একজন সদস্যের বিয়ে হচ্ছে, সেই উপলক্ষে প্রকাশনা। কেউ প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে যাচ্ছে বা কারো প্রথম সন্তানের জন্ম হচ্ছে, সেই উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা। সুনিলিত সাগরিতের সর্বশেষ সংখ্যাটি বের হয় আমার বড় মেয়ে নোভা। আহমেদের বিয়ে উপলক্ষে। পরিবারের বাইরের কারো লেখাই এখানে প্রকাশের নিয়ম নেই। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নোভাকে আশীবাদ জানিয়ে যে চারটি লাইন লিখেছিলেন তা পত্রিকায় ঢোকানো। তা সম্ভব হয় নি। সংসার ছেড়ে বাইরে চলে আসার কারণে পত্রিকাটির ওপর আমার কোনো। নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি নিজে যে লেখাটি লিখেছিলাম সেটিও প্রকাশ হবে কিনা তা নিয়েই শঙ্কিত ছিলাম।