ভালো।
বোন আছে না চলে গেছে?
গেছে গা।
আয় ভেতরে আয়।
মন্তাজ ভেতরে চলে এল। আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রায়ই খানিকটা গল্পগুজব হয়। মনে হয় আমাকে সে খানিকটা পছন্দ করে। এইসব ছেলেরা ভালোবাসার খুব কাঙাল হয়। অল্পকিছু মিষ্টি কথা, সামান্য একটু আদর—এতেই তারা অভিভূত হয়ে যায়। এইক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে বলে আমার ধারণা।
মন্তাজ এসে খাটের একপ্রান্তে বসল। আড়ে আড়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলি, কেমন?
আইচ্ছা।
ঠিকমতো জবাব দিবি তো?
হ।
আচ্ছা মন্তাজ, কবরে তুই জেগে উঠেছিলি, মনে আছে?
আছে।
যখন জেগে উঠলি তখন ভয় পেয়েছিলি?
না।
কেন?
মন্তাজ চুপ করে রইল। আমার দিক থেকে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, কী দেখলি—চারদিকে অন্ধকার?
হ।
কেমন অন্ধকার?
মন্তাজ এবারো জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে।
আমি বললাম, কবর তো খুব অন্ধকার। তবু ভয় লাগল না?
মন্তাজ নিচুস্বরে বলল, আরেকজন আমার সাথে আছিল, সেইজন্যে ভয় লাগে নাই।
আমি চমকে উঠে বললাম, আরেকজন ছিল মানে? আরেকজন কে ছিল?
চিনি না। আন্ধাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না।
ছেলে না মেয়ে?
জানি না।
সে কী করল?
আমারে আদর করল। আর কইল, কোনো ভয় নাই।
কীভাবে আদর করল?
মনে নাই।
কী কী কথা সে বলল?
মজার মজার কথা—খালি হাসি আসে।
বলতে বলতে মন্তাজ মিয়া ফিক করে হেসে ফেলল।
আমি বললাম, কী রকম মজার কথা? দু’একটা বল তো শুনি?
মনে নাই।
কিছুই মনে নাই? সে কে—এটা কি বলেছে?
জি-না।
ভালো করে ভেবেটেবে বল তো কোনোকিছু কি মনে পড়ে?
উনার গায়ে শ্যাওলার মতো গন্ধ ছিল।
আর কিছু?
মন্তাজ মিয়া চুপ করে রইল।
আমি বললাম, ভালো করে ভেবে-টেবে বল তো। কিছুই মনে নেই?
মন্তাজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা মনে আসছে।
সেটা কী?
বলতাম না। কথাডাঃ গোপন।
বলবি না কেন?
মন্তাজ জবাব দিল না।
আমি আবার বললাম–বল মন্তাজ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।
মন্তাজ উঠে চলে গেল।
.
এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। বাকি যে কদিন গ্রামে ছিলাম সে কোনোদিন আমার কাছে আসে নি। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি, তবু আসে নি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না।
কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলা-গন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।
১৮.
আমার জোছনাপ্রীতির বিষয়টা এখন অনেকেই জানেন। কেনইবা জানবেন না! জয়ঢাক পিটিয়ে সবাইকে জানিয়েছি। গান লিখেছি—
ও কারিগর দয়ার সাগর ওগো দয়াময়
চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।
শিল্পী এস আই টুটুল এই গানটির সুরকার। সে নানান অনুষ্ঠানে গানটা করে এবং গলা কাঁপিয়ে আবেগ জর্জরিত ভাষণ দেয়—
আমার স্যার, হমায়ুন আহমেদ, একদিন ডেকে বললেন, টুটুল, চান্নিপসর রাতে আমার মৃত্যু হবে। তখন তুমি এই গানটি আমার মৃতদেহের পাশে বসে গাইবে।
আমি যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে জানি মৃত মানুষ গানবাজনা শুনতে পারে না। সেখানে আমার শবদেহের পাশে টুটুলকে এই গান কেন করতে বলেছি বুঝতে পারছি না। সেই পরিস্থিতিতে টুটুল যদি গিটার বাজিয়ে গানে টান দেয়, তার ফল শুভ হবে বলেও তো মনে হচ্ছে না। মৃত্যুশোকে কাতর শাওন অবশ্যই টুটুলের গলা চেপে ধরবে।
যাই হোক, জোছনা নিয়ে আমার অনেক বাড়াবাড়ি আছে। একসময় নুহাশপল্লীতে প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা উৎসব হতো। এখন কিন্তু হয় না। অপূর্ব জোছনা রাতেও দরজা বন্ধ করে আমি ঝিম ধরে থাকি। শাওন খুবই বিস্মিত হয়। সে বলে, আকাশে এত বড় একটা চাঁদ উঠেছে, চল ছাদে যাই। আমি বলি, না।
না কেন?
ইচ্ছা করছে না।
সাম্প্রতিককালে আমি ‘ইচ্ছা করছে না’ ব্যাধিতে আক্রান্ত। চমৎকার সব ঘটনা চারপাশে ঘটছে। সেইসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হতে ইচ্ছা করে না।
লেখক মাত্রই জীবনে কয়েক দফা ইচ্ছা করে না ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এই ব্যাধি চিকিৎসার অতীত। একটা পর্যায়ে ব্যাধি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তখন লেখকের লিখতে ইচ্ছা করে না। তখন অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন।
উদাহরণ—
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
মায়াকোভস্কি
কাওয়াবা
লেখালেখি একধরনের থেরাপি। ব্যক্তিগত হতাশা, দুঃখবোধ থেকে বের হয়ে আসার পথ। আমি এই থেরাপি গ্রহণ করে নিজের মনকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করি। গ্রাহাম গ্রীনের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি—
Writing is a form of therapy; sometimes I wonder how all those who do not write, compose or paint can manage to escape the madness, the melancolia, the panic fear which is inherent in a human situation.
জোছনাপ্রীতি আমার এখনো আছে, প্রবলভাবেই আছে। তবে সাময়িকভাবে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছি। বাস করছি আপন অমাবস্যায়। কোনো এক চান্নিপসর রাতে আবারো বের হয়ে আসব। নুহাশ পল্লীতে চন্দ্রউৎসব হবে।
এখন চান্নিপসর আমার মাথায় কী করে ঢুকল সেই গল্প করি। দৈনিক বাংলায় লেখাটা প্রথম ছাপা হয়েছিল। তারিখ মনে নেই।
চান্নিপসর রাইত
আলাউদ্দিন নামে আমার নানাজানের একজন কমলা ছিল। তাকে ডাকা হতো আলাদ্দি। কামলাশ্রেণীর লোকদের পুরো নামে ডাকার চল ছিল না। পুরো নাম ভদ্রলোকদের জন্যে। এদের আবার নাম কী? একটা কিছু ডাকলেই হলো। ‘আলাদ্দি’ যে ডাকা হচ্ছে এই-ই যথেষ্ট।