মৌলানা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, বাইচ্যা আছে বুঝলা ক্যামনে?
রহিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি।
গ্রামের মৌলানারা অতি কঠিন হৃদয়ের হয় বলে আমাদের একটা ধারণী আছে। এই ধারণা সত্যি নয়। মৌলানা সাহেব বললেন, প্রয়োজনে কবর দ্বিতীয়বার খোঁড়া জায়েজ আছে। এই মেয়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করা যায়। হাদিস শরীফে আছে…
কবর খোঁড়া হলো।
ভয়াবহ দৃশ্য!
মন্তাজ মিয়া কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। হঠাৎ চোখে প্রবল আলো পড়ায় চোখ মেলতে পারছে না। কাফনের কাপড়ের একখণ্ড লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা। অন্য দুটি খণ্ড সুন্দর করে ভাঁজ করা।
অসংখ্য মানুষ জমা হয়ে আছে। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে কারো মুখে। কোনো কথা সরল না। মৌলানা সাহেব বললেন, কী রে মন্তাজ?
মন্তাজ মৃদুস্বরে বলল, পানির পিয়াস লাগছে।
মৌলানা সাহেব হাত বাড়িয়ে তাকে কবর থেকে তুললেন।
এই হচ্ছে মন্তাজ মিয়ার গল্প। আমি আমার এই জীবনে অদ্ভুত গল্প অনেক শুনেছি। এরকম কখনো শুনি নি।
ছোট চাচাকে বললাম, মন্তাজ তারপর কিছু বলে নি? অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরবার পর কী কী দেখল না-দেখল এইসব?
ছোট চাচা বললেন, না। কিছু কয় না। হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।
জিজ্ঞেস করেন নি কিছু?
কত জনে কত জিজ্ঞেস করছে। এক সাংবাদিকও আসছিল। ছবি তুলল। কত কথা জিজ্ঞেস করল–একটা শব্দ করে না। হারামজাদা বদের হাড়ি।
আমি বললাম, কবর থেকে ফিরে এসেছে–লোকজন তাকে ভয়-টয় পেত না?
প্রথম প্রথম পাইত। তারপর আর না। আল্লাতালার কুদরত। আল্লাতালার কেরামতি আমরা সামান্য মানুষ কী বুঝব কও?
তা তো বটেই। আপনারা তার বোন রহিমাকে জিজ্ঞেস করেন নি সে কী করে বুঝতে পারল মন্তাজ বেঁচে আছে?
জিজ্ঞেস করার কিছু নাই। এইটাও তোমার আল্লার কুদরত। উনার কেরামতি।
ধর্মকর্ম করুক বা না করুক, গ্রামের মানুষদের আল্লাহতায়ালার কুদরত এবং কেরামতির ওপর অসীম ভক্তি। গ্রামের মানুষদের চরিত্রে চমৎকার সব দিক আছে। অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এরা প্রচুর মাতামাতি করে, আবার অনেক বড় বড় ঘটনা হজম করে। দার্শনিকের মতো গলায় বলে, আল্লার কুদরত।
আমি ছোট চাচাকে বললাম, রহিমাকে একটু খবর দিয়ে আনানো যায় না?
ছোট চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
কথা বলতাম।
খবর দেওয়ার দরকার নাই। এম্নেই আসব।
এম্নিতেই আসবে কেন?
ছোট চাচা বললেন, তুমি পুলাপনি নিয়া আসছ। চাইরদিকে খবর গেছে। এই গ্রামের যত মেয়ের বিয়া হইছে সব অখন নাইওর আসব। এইটাই নিয়ম।
আমি অবাক হলাম। সত্যি সত্যি এটাই নাকি নিয়ম। গ্রামের কোনো বিশিষ্ট মানুষ আসা উপলক্ষে গ্রামের সব মেয়ে নাইওর আসবে। বাপের দেশে আসার এটা তাদের একটা সুযোগ। এই সুযোগ তারা নষ্ট করবে না।
আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছে?
আসব না মানে? গেরামের একটা নিয়মশৃখলা আছে না?
আমি ছোট চাচাকে বললাম, আমাদের উপলক্ষে যেসব মেয়ে নাইওর আসবে তাদের প্রত্যেককে যেন একটা করে দামি শাড়ি উপহার হিসেবে দেয়া হয়। একদিন খুব যত্ন করে দাওয়াত খাওয়ানো হয়।
ছোট চাচা এটা পছন্দ করলেন না, তবে তার রাজি না হয়েও কোনো উপায় ছিল না। আমাদের জমিজমা তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছেন।
গ্রামের নিয়মমতো একসময় রহিমাও এল। সঙ্গে চারটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। হতদরিদ্র অবস্থা। স্বামীর বাড়ি থেকে সে আমার জন্যে দু’টা ডালিম নিয়ে এসেছে।
আমার স্ত্রী তাকে খুব যত্ন করে খাওয়াল। খাওয়ার শেষে তাকে শাড়িটি দেয়া হলো। মেয়েটি অভিভূত হয়ে গেল। একরকম একটা উপহার বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ রহিমা?
রহিমা ফিসফিস করে বলল, ভালো আছি ভাইজান।
শাড়ি পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ হইব না! কী কন ভাইজান? অত দামি জিনিস কি আমরা কোনোদিন চউক্ষে দেখছি?
তোমার ভাইয়ের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী করে বুঝলে ভাই বেঁচে আছে?
রহিমা অনেকটা চুপ করে থেকে বলল, কী কইরা বুঝলাম আমি নিজেও জানি ভাইজান। মৃত্যুর খবর শুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসছি। বাড়ির উঠানে পাও দিতেই মনে হইল মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে।
কী জন্যে মনে হলো?
জানি না ভাইজান! মনে হইল।
এই রকম কি তোমার আগেও হয়েছে? মানে কোনো ঘটনা আগে থেকেই কি তুমি বলতে পার?
জি-না।
মন্তাজ তোমাকে কিছু বলে নি? জ্ঞান ফিরলে সে কী দেখল বা তার কী মনে হলো?
জি-না।
জিজ্ঞেস কর নি?
করছি। হারামজাদা কথা কয় না।
রহিমা আরো খানিকক্ষণ বসে পান-টান খেয়ে চলে গেল।
আমার টানা লেখালেখিতে ছেদ পড়ল। কিছুতেই আর লিখতে পারি না। সবসময় মনে হয়, বাচ্চা একটি ছেলে কবরের বিকট অন্ধকারে জেগে উঠে কী ভাবল? কী সে দেখল। তখন তার মনের অনুভূতি কেমন ছিল?
মন্তাজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আবার মনে হয়—জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলেকে ভয়স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়াটা অন্যায় কাজ। এই ছেলে নিশ্চয়ই প্রাণপণে এটা ভুলতে চেষ্টা করছে। ভুলতে চেষ্টা করছে বলেই কাউকে কিছু বলতে চায় না। তবু একদিন কৌতূহলের হাতে পরাজিত হলাম।
.
দুপুরবেলা।
গল্পের বই নিয়ে বসেছি। পাড়াগাঁর ঝিম ধরা দুপুর। একটু যেন ঘুমঘুম আসছে। জানালার বাইরে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি মন্তাজ। আমি বললাম, কী খবর মন্তাজ?