তার চিৎকারে আমার ঘুম ভাঙল। পুত্র নিষাদ জেগে উঠে কান্না শুরু করল। শাওন চিৎকার করেই যাচ্ছে, এটা কী? এটা কী?
হাঁটু গেড়ে যে বসে ছিল সে উঠে দাঁড়াল। শান্ত ভঙ্গিতে শোবার ঘর থেকে করিডোরে গেল। ততক্ষণে আমার সংবিত খানিকটা ফিরেছে। শাওন যেদিকে আঙুল দেখাচ্ছে আমি সেদিকে তাকালাম। আমার চোখে চশমা নেই, আমি স্পষ্ট কিছু দেখছি না। তারপরেও মূর্তিকে দেখলাম। সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে করিডোরের শেষপ্রান্তের দরজা বন্ধ করল। আমার কাছে মনে হলো নারী মূর্তি।
এর মধ্যে ঘরের বাতি জ্বালানো হয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে করিডোরের দরজা খুলেছি। কোথাও কেউ নেই।
জুয়েল আইচ বললেন, ভূত-প্রেত কিছু হতেই পারে না। যে ঘরে ঢুকেছে সে মানুষ। কারণ করিডোরের বাতি আগে জ্বালানো ছিল। যে ঘরে ঢুকেছে সে নিজের পরিচয় গোপন রাখার জন্যে বাতি নিভিয়ে ঢুকেছে।
যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না। কারণ সে ঘরে ঢুকে হাঁটু গেড়ে পিঠে হাত রেখে বসে থাকবে কেন? আমাদের সম্মিলিত বিকট চিঙ্কারেও তার কোনো বিকার হবে না কেন? দৌড়ে পালিয়ে না গিয়ে সে কেন অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে বের হবে?
নুহাশ পল্লীতে আমি যখন রাত্রি যাপন করি, তখন দু’জন সিকিউরিটি গার্ড সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কারো আমার শোবার ঘরে ঢোকার প্রশ্নই আসে না।
ঘটনা যা ঘটেছে তা দিয়েই চমৎকার একটা ভূতের গল্প লেখা যায়। বাড়তি আমি যা যোগ করব বলে ভেবে রেখেছি তা হলো, পরদিন দেখা গেল শাওনের পিঠে মানুষের হাতের ছাপের মতো কালো ছাপ। সেই ছাপে পাঁচটা আঙুলের জায়গায় ছয়টা আঙুল।
ভৌতিক গল্পের উপকরণ আমি সবসময় হাতের কাছেই পাই। গ্রামের বাড়িতে মন্তাজ মিয়া নামের একটি নয়-দশ বছরের বালকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। বালকটি মারা গিয়েছিল। তাকে কবর দেয়া হয়েছিল। চব্বিশ ঘণ্টা পর কবর খুঁড়ে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তেমন কোনো রদবদল ছাড়াই বালকটির সঙ্গে আমার কথাবার্তা যা হয়েছিল তা নিয়ে একটি গল্প লিখি। পাঠকদের জন্যে গল্পটা দিয়ে দিলাম।
ছায়াসঙ্গী
প্রতিবছর শীতের ছুটির সময় ভাবি কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসব। দলবল নিয়ে যাব—হৈচৈ করা যাবে। আমার বাচ্চারা কখনো গ্রাম দেখে নি, তারা খুশি হবে। পুকুরে ঝাপাঝাপি করতে পারবে। শাপলা ফুল শুধু যে মতিঝিলের সামনেই ফোটে না, অন্যান্য জায়গাতেও ফোটে তাও স্বচক্ষে দেখবে।
আমার বেশির ভাগ পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারি না। এটা কেমন করে জানি লেগে গেল। একদিন সত্যি সত্যি রওনা হলাম।
আমাদের গ্রামটাকে অজপাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন সুন্দর সময়েও সেখানে পৌঁছতে হয় গরুর গাড়িতে। বর্ষার সময়। নৌকা, তবে মাঝখানে একটা হাওড় পড়ে বলে সেই যাত্রী অগস্ত্যযাত্রার মতো।
অনেকদিন পর গ্রামে গিয়ে ভালো লাগল। দেখলাম আমার বাচ্চাদের আনন্দ বর্ধনের সব ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। কোত্থেকে যেন একটা হাড় জিরজিরে বেতো ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে। এই ঘোড়া নড়াচড়া করে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। খুব বেশি বিরক্ত হলে দীর্ঘনিঃশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে এবং লেজটা নাড়ে। বাচ্চারা এত বড় একটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে মহাখুশি, দু’তিনজন একসঙ্গে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে।
তাদের অসংখ্য বন্ধুবান্ধবও জুটে গেল। যেখানেই যায় তাদের সঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক ছেলেপুলে থাকে। আমার বাচ্চারা যা করে তাতেই তারা চমৎকৃত হয়। আমার বাচ্চারা তাদের বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিভূত। তারা তাদের যাবতীয় প্রতিভা দেখাতে শুরু করল—কেউ কবিতা বলছে, কেউ গান, কেউ ছড়া।
আমি একগাদা বই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিকল্পনা পুরোপুরি বিশ্রাম নেয়। শুয়ে-বসে বই পড়া, খুব বেশি ইচ্ছা করলে খাতা-কলম নিয়ে বসা। একটা উপন্যাস অর্ধেকের মতো লিখেছিলাম, বাকিটা কিছুতেই লিখতে ইচ্ছা করছিল না। পাণ্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, নতুন পরিবেশে যদি লিখতে ইচ্ছা করে।
প্রথম কিছুদিন বই বা লেখা কোনোটাই নিয়ে বসা গেল না। সারাক্ষণই লোকজন আসছে। তারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নানা জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী। এসেই বলবে–দেশের অবস্থা কী কন দেহি ছোড মিয়া! বড়ই চিন্তাযুক্ত আছি। দেশের হইলডা কী? কী দেশ ছিল আর কী হইল!
দিন চার-পাঁচেকের পর সবাই বুঝে গেল দেশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। গল্পগুজবও তেমন করতে পারি না। তারা আমাকে রেহাই দিল আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। গ্রামের নতুন পরিবেশের কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, আমি লেখালেখির প্রবল আগ্রহ বোধ করলাম। অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসলাম, সারাদিন লেখালেখি কাটাকুটি করি। সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সঙ্গে করে বেড়াতে বের হই। চমৎকার লাগে। প্রায় রাতেই একজন দু’জন করে ‘গাতক’ আসে। এরা জ্যোস্নাভেজা উঠোনে বসে চমৎকার গান ধরে —
ও মনা
এই কথাটা না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।
না না আমি প্রাণে বাঁচতাম না।
সময়টা বড় চমৎকার কাটতে লাগল। লেখার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়তেই লাগল। সারাদিনই লিখি।
এক দুপুরের কথা। একমনে লিখছি। জানালার ওপাশে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি খালি গায়ে রোগামতো দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে আগেও দেখেছি। জানালার ওপাশ থেকে গভীর কৌতূহলে সে আমাকে দেখে। চোখে চোখ পড়লেই পালিয়ে যায়। আজ পালাল না।