পার্টি ভেঙে গেল। সবাই ঘরে চলে এলাম। যে মেয়েটি প্রথম ছায়ামূর্তি দেখেছে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার মাথায় পানি ঢালা হতে লাগল।
প্রায় চল্লিশজন অতিথির সবাই স্বীকার করলেন, তার ব্যাখ্যার অতীত একটি ঘটনা দেখলেন। এদের মধ্যে ঔপন্যাসিক মঈনুল আহসান সাবেরও ছিলেন। যদিও তিনি ঢাকায় এসে এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তার ধারণা নুহাশ পল্লীর লোকজন ছাদ থেকে নানান ধরনের আলো ফেলে এই ছায়ামূর্তি তৈরি করেছে।
তার ধারণা সত্যি নয়। নুহাশ পল্লীর বাংলোতে ছাদে ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের হাতে এমন কোনো যন্ত্রপাতি নেই যা দিয়ে এমন স্পষ্ট ছায়ামূর্তি (যা উঠবোস করে) তৈরি করা যায়। স্পিলবার্গের কাছে থাকলেও থাকতে পারে।
প্রিয় পাঠক! আমি আপনাকে ভূতে বিশ্বাস করাতে চাচ্ছি না। শুধু বলতে চাচ্ছি, জগতে কিছু ব্যাখ্যার অতীত ঘটনা ঘটে। ঘটনা ঘটে বলেই জগতটাকে ‘Interesting’ মনে হয়।
আমি আমার এক জীবনে (ষাট বছরে) অনেক ব্যাখ্যার অতীত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। একটি বলি।
১৯৭১ সন। এপ্রিল মাস। আমরা পিরোজপুরে আছি। মিলিটারি তখনো পিরোজপুরে আসে নি। ভয়ে-আতঙ্কে সবাই অস্থির। এক ভোরবেলার ঘটনা। সব ভাইবোনরা মা’কে ঘিরে আছি। কারণ তিনি না-কি রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা বলছেন।
“আমি স্বপ্নে দেখলাম এই বাড়িটাই। তোরা এখন যেমন আমাকে ঘিরে বসে আছিস—স্বপ্নেও সেরকম আমাকে ঘিরে বসা। হঠাৎ সেখানে নয় দশ বছরের একটা মেয়ে ঢুকে বলল, আমার নাম লতিফা। আপনি কি আমাকে চিনেছেন?”
আমার মা স্বপ্নের এই অংশটি বলে শেষ করতেই নয়-দশ বছরের একটি মেয়ে চুকল। স্পষ্ট গলায় বলল, “আমার নাম লতিফা। আপনি কি আমাকে চিনেছেন? আমরা বাগেরহাট থেকে মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে এসেছি। এখন আপনাদের সঙ্গে থাকব।…”
এই ঘটনার ব্যাখ্যা কি সত্যিই আছে?
আমার বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগের একটি হচ্ছে, আমি ভূত নামক অর্থহীন বিষয় নিয়ে প্রচুর গল্প লিখি। এবং পাঠককে বাধ্য করি ভূতে বিশ্বাস করাতে। তারা শেষ পর্যন্ত ভূতে বিশ্বাস করে এবং মহাসমস্যায় পড়ে।
বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়েই যে ভূত আছে তা কি পাঠকরা। জানেন? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ভূত বিশ্বাস করতেন। পরকালে বিশ্বাস করতেন। ভূত বিষয়ে তার অসাধারণ সব গল্প আছে। তার একটি উপন্যাস দেবযান পরকাল নিয়ে লেখা। বিভূতিভূষণের মৃত্যুও কিন্তু যথেষ্টই রহস্যময়। তিনি তখন থাকেন ঘাটশিলায়। এক সন্ধ্যায় বেড়াতে বের হয়েছেন—হঠাৎ দেখেন একদল শবযাত্রী খাঁটিয়াতে করে শবদেহ নিয়ে যাচ্ছে। তারা বিভূতিভূষণকে দেখে খাঁটিয়া নামালো। তিনি খাঁটিয়ার কাছে গিয়ে দেখেন, শবদেহ আর কারোর না। তার নিজের। তিনি নিজের মৃতদেহ দেখে ছুটে বাড়িতে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে অসুস্থতাতেই তাঁর মৃত্যু।
বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল লেখকের নাম বনফুল (বলাইচাঁদ মুখাপাধ্যায়)। তিনি ভূত-প্রেত মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। প্রচলিত আছে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই একজন ঘোর নাস্তিকও আস্তিক হয়ে ফিরত।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত আমার প্রিয় লেখকদের একজন (প্রথম কদম ফুল,..)। তিনি শুধু যে ভূত বিশ্বাস করতেন তা-না, নিয়মিত ভূত-প্রেতের সঙ্গে কথাবার্তাও বলতেন।
‘রবীন্দ্রনাথের প্রেতচর্চা’ নামের একটা বই পড়ে জেনেছি পরকাল বিষয়ে তাঁর আগ্রহের কথা। পরকাল, জন্মান্তর, ভূত-প্রেত বিষয়ে তাঁর চিন্তার সার কথা তিনি লিখেছেন এই কয়েকটি লাইনে—
“চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর।
জন্মান্তের নবপ্রাতে, সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তর।”
.
কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী শাওনের একটি ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে একটা গল্প লেখা শুরু করেছি, নাম–”কে?” আমার সব অতিপ্রাকৃত গল্পে ‘Personal experience’-এর কিছু ব্যাপার থাকে। অন্যের অভিজ্ঞতা যে ধার করি না তাও না।
বলপয়েন্ট লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে ছোট্ট ভুল অতীতে করেছি। আমার লেখা প্রতিটি অতিপ্রাকৃত গল্পের ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। গল্পটা কেন লিখলাম। শানে নজুলটা কী। এখন থেকে তাই করব।
যাই হোক, শাওনের ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্পটি করি। জাদুকর জুয়েল আইচ এই অভিজ্ঞতার লৌকিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। আমি তার ব্যাখার সঙ্গে একমত নই। কারণ শাওনের ভৌতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমিও কিছুটা যুক্ত।
স্থান নুহাশ পল্লী। রাত দুটা। ঈদের নাটকের শুটিং (এনায়েত আলীর ছাগল) এইমাত্র শেষ হয়েছে। আমরা ঘুমুতে এসেছি। আলো থাকলে আমার ঘুম আসে না। বাতি নেভানো। আলো ছাড়া পুত্র নিষাদ ঘুমুতে পারে না। করিডোরের বাতি জ্বালানো। দরজা অর্ধেক খোলা। খোলা দরজায় যথেষ্টই আলো আসছে। সারাদিনের পরিশ্রমে বিছানায় যাওয়া মাত্রই তিনজনই গভীর ঘুমে। এই সময় শীওন একটা দুঃস্বপ্ন দেখল। দুঃস্বপ্নে কে যেন তার গা ঘেঁসে শুয়ে আছে। আমি তাকে বলছি–এই, তোমার পাশে এটা কী? শাওন জেগে উঠল। শাওনের স্বভাব। হচ্ছে, রাতে যে-কোনো কারণে ঘুম ভাঙলেই আমাকে ডাকবে। আমার কাঁচা ঘুম। ভাঙার যন্ত্রণা সে আমলেই নেবে না। সে যথারীতি আমাকে ডেকে তুলল। বলল, ভয় পেয়েছি। পানি খাব। তার হাতের কাছেই পানির বোতল। সেই বোতল। আমাকে তুলে দিতে হলো। পানি খেয়ে আবার ঘুমুতে গেল। আবার ঘুম ভাঙল। এবার দুঃস্বপ্ন দেখে না। তার কাছে মনে হলো, কে যেন তার পিঠে হাত রেখেছে। সে ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল—খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে একজন বসে আছে। চাঁদরে তার গা ডাকা। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ করিডোরের বাতি নিভানো। শাওন বিকট চিৎকার শুরু করল, এটা কী? এটা কী?