আমি ম্যাজিশিয়ানকে একদিন বললাম, পামিং শিখতে চাই। কতদিন লাগবে?
তিনি বিড়ি ধরাতে ধরতে বললেন, কমের পক্ষে কুড়ি বছর। প্রথম দশ বছর পয়সা হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে।
হাতে নিয়ে ঘুরলেই হবে, আর কিছু না?
না। দশ বছরে পয়সা হাতরে চিনবে, হাত পয়সারে চিনবে। দুইজনের ভিতর মহব্বত হবে।
আমি কয়েন হাতে নিয়ে ঘুরতে শুরু করলাম। সবসময় হাতে কয়েন। কখনো একটা। কখনো দুটা।
ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক থাকেন চানখাঁর পুলে। মাঝে মধ্যে তার ছাপড়ায় বেড়াতে যাই। তিনি আমাকে দেখে খুশিও হন না, বিরক্তও হন না। মন ভালো থাকলে এক-আধটা ম্যাজিক দেখান। একদিনের কথা। উনার মেজাজ খুব ভালো। আমাকে দেখেই বললেন, এখান থেকে যে-কোনো একটা তাশ নাও।
আমি নিলাম হার্টসের দুই।
ম্যাজিশিয়ান হাই তুলতে তুলতে বললেন, পানির গ্লাসের ভিতর তাকিয়ে দেখ কিছু দেখা যায় কি-না।
আমি অবাক হয়ে দেখি, পানির গ্লাসে হার্টসের দুই-এর ছায়া। আমি মন্ত্রমুগ্ধ। ম্যাজিশিয়ান বললেন, আমি শিষ্য নেই না। শিষ্য নিলে তোমারে নিতাম। তবে যদি পার আমাকে তিনশ’ টাকা দিও। এমন একটা ম্যাজিক তোমাকে শিখায়ে দিব বাকি জীবন করে খেতে পারবে।
তিনশ’ টাকা তখন অনেক টাকা। হোস্টেলের ফুড চার্জ মাসে চল্লিশ টাকা। ষাট টাকায় আমার মাস চলে। সেখানে কোথায় পাব তিনশ’ টাকা?
একসময় ছয় মাসের স্কলারশিপের টাকা একসঙ্গে পেলাম। প্রায় একহাজার টাকা। সেখান থেকে তিনশ’ টাকা নিয়ে গেলাম ম্যাজিশিয়ানের কাছে। তিনি তিনশ’ টাকা রেখে পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে যেতে বললেন। আমি গেলাম এবং শুনলাম ম্যাজিশিয়ান ছাপড়া ছেড়ে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন কেউ জানে না।
পাঠকের ধারণা হতে পারে এই ঘটনার পর আমি ম্যাজিকচর্চা ছেড়ে দিয়েছি। তা কিন্তু হয় নি। পামিং শেখা চালিয়ে গেছি। ম্যাজিকের বইপত্র জোগাড় করেছি। যে যা জানে তার কাছেই শেখার চেষ্টা করেছি।
যে মানুষটি এই ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন, তার নাম জুয়েল আইচ। তাঁর কল্যাণেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যাদু সংস্থা—-International Brotherhood of Magicians-এর আমি সদস্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি ম্যাজিক দেখাই?
উত্তর হলো, না।
আমি ম্যাজিকটা করি সম্পূর্ণই আমার নিজের জন্যে। হঠাৎ হঠাৎ শাওনকে একটা কৌশল দেখাই। সে মুগ্ধ হবার অভিনয় করে। এতেই আমি খুশি।
বলপয়েন্টে ম্যাজিকের অংশটা বিস্তারিত লেখার কারণটা বলি? আমার লেখালেখিতে Magician-এর চরিত্র অনেকবার উঠে এসেছে। পাঠকদের কি মনে আছে এইসব দিনরাত্রি-র আনিসের কথা? যে চিলেকোঠায় থাকতো। ম্যাজিক দেখাতে।
আমি বাস করি ম্যাজিকের জগতে। ছোট্ট নিষাদ যখন হাসে, সেই হাসিতে ম্যাজিক। তার মা যখন গান করে, তাতেও ম্যাজিক। আমি যখন একটি চরিত্র সৃষ্টি করি, সেখানেও ম্যাজিক।
আমার সেই মহান ম্যাজিশিয়ানের স্বরূপ জানতে ইচ্ছা করে, যিনি আমাদের সবাইকেই অন্তহীন ম্যাজিকে ডুবিয়ে রেখেছেন।
১৭.
স্যার, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন?
না।
তাহলে এত ভূতের গল্প কেন লিখেছেন?
তোমাদের ভয় দেখানোর জন্যে। মানুষ নিরাপদ জায়গায় বসে ভয় পেতে ভালোবাসে।
স্যার, ভূত কখনো দেখেছেন?
তুমি দেখেছ?
জি। ঘটনা বলব?
বলো।
আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সামারের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি। বর্ষাকাল। বৃষ্টি পড়ছে না, তবে আকাশে ঘন মেঘ। যে-কোনো সময় বর্ষণ শুরু হবে। সন্ধ্যার পর পর আমি নৌকায় কাওরাইদ পৌঁছলাম। কিছুটা রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। গোরস্থানের পাশ দিয়ে রাস্তা। লোক চলাচল নেই বললেই হয়…
.
শুরু হয়ে গেল ভূতের গল্প। আমি এখন পর্যন্ত এমন কাউকে পাই নি যার ঝুলিতে কোনো ভৌতিক অভিজ্ঞতা নেই। নাস্তিকরা এই বিষয়ে অনেক এগিয়ে। তারা ভূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাদের ভৌতিক অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি। এমন একজন হলেন অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় কঠিন নাস্তিক। তিনি ঈশ্বর, ভগবান, ভূতপ্রেত কিছুই বিশ্বাস করেন না। এক সন্ধ্যায় নুহাশ পল্লীতে একটা ঘটনা ঘটল। তিনি দেখলেন এবং ভীত গলায় বললেন, আমি ভগবানকে বিশ্বাস করি না, কিন্তু নুহাশ পল্লীর ভূত বিশ্বাস করি।
ঘটনাটা বলি।
নুহাশ পল্লীতে কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। সন্ধ্যা পার হয়েছে। অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে আলোকসজ্জা। হাজারখানিক মোমবাতি চারিদিকে জ্বালানো হয়েছে। বারবিকিউয়ের প্রস্তুতি চলছে। সুইমিং পুলের চারপাশে সবাই জটলা করছে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্প চলছে। মেয়েরা পুরুষদের গল্প পছন্দ করলেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে তারা আলাদা হয়ে যায়। মেয়েরা মেয়েরা গল্প করে। অনেকের ধারণা তাদের গল্পের বিষয়—শাড়ি, গয়না। তা কিন্তু না। মূল বিষয় কাজের বুয়া সমস্যা।
পার্টি জমে উঠেছে। হঠাৎ মেয়েদের মধ্যে কেউ বিস্মিত গলায় আঙুল উঁচিয়ে বলল, এটা কী?
আমরা সবাই তাকালাম। সুইমিং পুলের পেছনে জবা গাছের ঝাড়। ঘন জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। সেই ঘন জংলায় একটি মেয়েমানুষের মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মূর্তিটি মনে হচ্ছে আলোর তৈরি। সে দাঁড়ানো থেকে বসছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে।
সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। নুহাশ পল্লীর একজন কর্মচারী কে? কে? বলে জংলার দিকে ছুটে যেতেই ছায়ামূর্তি সবার চোখের সামনে মিলিয়ে গেল।