আমার ক্লাস করতে ভালো লাগে না। পাঠ্যবই পড়তে ভালো লাগে না। হোস্টেলের খাবার ভালো লাগে না। ঢাকায় থাকতে ভালো লাগে না।
ক্লাস করা প্রায় ছেড়েই দিলাম। আমার মামা তা টের পেলেন না। কারণ তিনি অন্য সেকশানের ছাত্র। ক্লাসে যাওয়া ছেড়ে দেয়ার শুরুটা বেশ মজার। বাংলার একজন শিক্ষক, নাম আজিজুর রহমান। তিনি ক্লাস নিতে এসে বললেন, অনেক ছেলেই ক্লাসে আসে শুধুমাত্র পার্সেন্টেজের জন্যে। তাদেরকে জানাচ্ছি, তারা ক্লাসে না এলেও চলবে। আমি সবাইকে পার্সেন্টেজ দেই।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, কিছু বলবে?
আমি বললাম, জি-না স্যার। আমি চলে যাব।
স্যার বিস্ময়ের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি গটগট করে বের হয়ে এলাম। পরে জানলাম আজিজুর রহমানই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান। তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি করেছি ভেবে মন খারাপ হলো এবং ঠিক করলাম অন্যক্লাস না করলেও আমি তার ক্লাসগুলি করব।
শওকত ওসমান স্যারের ক্লাস করতে গিয়ে হতাশই হয়েছি। মূল বিষয় নিয়ে তিনি অল্পই কথা বলতেন যেমন, একদিন পুরো ক্লাসে বললেন তিনি একটা পেইন্টিং কিনেছেন সে-গল্প। একজন শিক্ষকের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্যারের কথা জড়িয়ে যেত। এবং আমার সবসময় মনে হতো তিনি সময়। কাটানোর জন্যেই কথা বলছেন।
আমাদের আরেকজন বাংলার শিক্ষক ছিলেন। মোটা, বেঁটে। তাঁর নাম মনে পড়ছে না। তিনি ক্লাসে ঢুকেই নানান ধরনের জোকারি করতেন। অঙ্গভঙ্গি করতেন। বিচিত্র শব্দ করতেন। ছাত্ররা খুবই মজা পেত। ক্লাস শেষ হবার পর বলতেন, একটা ঘন্টা আনন্দ করে পার করেছ এটাই লাভ। জগতে আনন্দই সত্য।
স্যারের গোপাল ভাঁড়ের মতো আচরণ আমার অসহ্য লাগত। একজন শিক্ষক ক্লাসে ছাত্র পড়াবেন। তাদের হাসানোর দায়িত্ব নেবেন না।
একদিন স্যার বললেন, কারো কোনো প্রশ্ন আছে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, কী জানতে চাও হে খোকা?
খোকা ডাকায় ক্লাসে হো হো হাসি শুরু হলো। হাসির শব্দ থামার পর আমি বললাম, স্যার, ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘোরে। নিউক্লিয়াস কি স্থির হয়ে থাকে? না-কি সেও ঘোরে?
স্যার কিছুক্ষণ হতভম্ব অবস্থায় কাটালেন। তারপর বললেন, বাংলা ক্লাসে তুমি সায়েন্স নিয়ে এসেছ কেন? বাংলা বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে কর।
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, স্যার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাশুড়ির নাম জানতে চাচ্ছিলাম।
স্যার একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও তাকিয়ে আছি। ছাত্ররা হো হো হাসতে শুরু করেছে।
আমি মোটেই বেয়াদব ছাত্র না। বরং একটু বেশিরকমই বিনয়ী। কিন্তু শিক্ষকদের ফাঁকিবাজিটা কখনোই নিতে পারতাম না।
ঢাকা কলেজে ভালো শিক্ষক কি ছিলেন না?
অনেক ছিলেন। সিরাজুল হক নামের একজন অংকের শিক্ষক ছিলেন, তিনি পড়াতেন কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রি! ওরকম শিক্ষক পাওয়া ভাগের ব্যাপার।
প্রফেসর নোমান পড়াতেন ইংরেজি কবিতা। কী সুন্দর কণ্ঠ! কী চমৎকার পড়ানোর ভঙ্গি!
শিক্ষকদের কথা থাকুক, তাঁদের ছাত্রের কথা বলি। ছাত্র ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কী করত? হন্টন করত।
হ্যাঁ, আমার প্রধান কাজ ছিল ঢাকা শহর চষে বেড়ানো। মাঝে মাঝে বলাকা সিনেমাহলে ম্যাটিনি শোতে ইংরেজি ছবি দেখা। দেশের প্রধান তখন ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান। ছাত্রদের প্রতি তার অনেক মমতা (!), ছাত্ররা যেন অর্ধেক টাকায় ছবি দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা তিনি করেছেন। ছাত্রদের জন্যে সিনেমাহলে টিকিটের দাম অর্ধেক। ছাত্রদের সস্তায় সিনেমা দেখানোর জন্যে এই রাষ্ট্রপ্রধানের এত আগ্রহের কারণ কী কে জানে!
ঢাকার পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে একবার এক ম্যাজিশিয়ানের দেখা পেলাম। বেশির ভাগ সময়ই ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখাবার পর ওষুধ বিক্রি করে। এই ম্যাজিশিয়ান সেরকম না। তিনি ম্যাজিকের কৌশল টাকার বিনিময়ে শিখিয়ে দেন। কেউ যদি সেই আইটেম কিনতে চায় তাও তিনি বিক্রি করেন। আমি তার ম্যাজিক দেখে মুগ্ধ। চারটা তাশ নিয়েছেন। চার বিবি। ফুঁ দেয়া মাত্র বিবিদের ছবি মুছে গেল। হয়ে গেল চারটা টেক্কা।
এই ম্যাজিকটার দাম পাঁচ টাকা। আমি পাঁচ টাকা দিয়ে ম্যাজিকটা কিনলাম। ম্যাজিশিয়ান আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কৌশল ব্যাখ্যা করলেন এবং চারটা তাশ আমাকে দিয়ে দিলেন।
ম্যাজিকের কৌশল শেখার পর সবারই ধাক্কার মতো লাগে। মন খারাপ হয়ে যায়। কৌশল এত সহজ! আমি মুগ্ধ হলাম। মানুষকে এত সহজে বিভ্রান্ত করা যায়।
এরপর থেকে আমার কাজ হয়ে দাঁড়াল ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোককে খুঁজে বের করা। ঘণ্টার পর ঘন্টা তার ম্যাজিক দেখা এবং অতি সস্তায় কিছু ম্যাজিক তার কাছ থেকে কেনা। কারণ টাকা নেই। নাশতা খাবার জন্য যে টাকা বাবা পাঠান, তার একটা বড় অংশই এখন চলে যাচ্ছে ম্যাজিকের কৌশল কেনায়। সারাক্ষণ মনে হয় যদি প্রচুর টাকা থাকত, তাহলে এই লোকটার সব ম্যাজিক আমি কিনে নিতাম।
ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে আমার কিছুটা খাতিরও হলো। ভদ্রলোকের নাম মনে নেই, তবে তার ওস্তাদের নাম মনে আছে। ওস্তাদের নাম যদু বাবু। ম্যাজিশিয়ান কথায় কথায় যদু বাবুর প্রসঙ্গ আনতেন। যেমন—
আমার ওস্তাদ যদু বাবু বলতেন যারা ম্যাজিকের জিনিসপত্র দিয়ে ম্যাজিক দেখায়, তারা ম্যাজিশিয়ান সমাজের কলঙ্ক। হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে যারা খেলা দেখায় তারাই খেলোয়াড়।