স্যার লিখছেন—শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিখ্যাত সব শিক্ষকের মিলনক্ষেত্র। অতি বিখ্যাত সব শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু গুণী কোনো ছাত্র বের করতে পারে নি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৌলুশ কমে গেল। মোটামুটি মানের শিক্ষকরা শিক্ষকতা শুরু করলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন অসাধারণ মেধার মানুষ বের করতে শুরু করল। যেমন, কবি শামসুর রাহমান, ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ।
আমি ভেবেই পাচ্ছি না, যে হুমায়ূন আহমেদের কথা লেখা হচ্ছে সে কি আমি? আরো কোনো হুমায়ূন আহমেদ কি আছে? যদি আমি সেই হুমায়ুন আহমেদ হয়ে থাকি, তাহলে তো আমার এই লেখা অনুবাদ করা ঠিক হবে না।
পাণ্ডুলিপি নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি পাণ্ডুলিপি পড়ে বললেন—আপনার নামই তো মনে হচ্ছে। আপনি এক কাজ করুন—রাজ্জাক সাহেবের কাছে যান, তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করুন। উনি ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে থাকেন। একা মানুষ। এখনি চলে যান।
আমি স্যারের বাসায় গেলাম। তার বসার ঘরটা প্রকাণ্ড। সেখানে কোনো সোফা নেই। ঘরের মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা মশারি খাটানো। স্যার মশারির ভেতর চেয়ার-টেবিল পেতে পড়াশোনা করছেন। মশার হাত থেকে মুক্ত থেকে পড়াশোনা করার চমৎকার ব্যবস্থা। স্যার আমাকে দেখে মশারির ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। আমি আমার সমস্যার কথা বললাম।
স্যার বললেন, আমি আপনার কথাই লিখেছি এবং কোনো ভুল করি নি। যেভাবে লিখেছি সেভাবেই যেন অনুবাদ করা হয়।
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে খুব আগ্রহ করে বক্তৃতা শুনতে গিয়েছি। প্যান্ডেল সাজিয়ে বিশাল আয়োজন। স্যার বক্তৃতা শেষ করলেন। তুমুল করতালি। আমি ভ্যাবদা মেরে বসে আছি, কারণ বক্তৃতায় হুমায়ুন আহমেদের অংশটা নেই। স্যার যে পড়তে ভুলে গেছেন তাও না। মূল বক্তৃতা বুকলেট আকারে সবাইকে দেয়া হয়েছে। সেখানেও এই অংশ নেই।
খুবই তুচ্ছ বিষয়। মাঝে মাঝে তুচ্ছ বিষয় চোরাকাটার মতো মনে লেগে থাকে। ব্যথা দেয় না, অস্বস্তি দেয়।
কয়েকদিন পর রাজ্জাক স্যার পিয়ন পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। রাতে তাঁর বাসায় খাবার নিমন্ত্রণ। নিমন্ত্রণ খেতে গেলাম। বিশাল আয়োজন। অনেক অতিথি। সবাই অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমি শুধু নামগোত্রহীন। ‘হংস মধ্যে কাক’ যথা, বকও না। স্যার এক ফাঁকে বললেন, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?
আমি বললাম, জি-না স্যার।
স্যার বললেন, বক্তৃতার অনুবাদ ভালো হয়েছে। বক্তৃতা বিষয়ে কিছু বলবেন?
আমি বললাম, জি-না।
সবাই খেতে বসেছি। স্যার আমাকে বসিয়েছেন তার পাশে। প্রচুর খাবার দাবার। এর মধ্যে একটি আইটেম স্যারের রান্না করা। উনি খেতে পছন্দ করতেন। রান্নার ব্যাপারেও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। খাবার টেবিলে আরেকটি ব্যাপার আমাকে বিস্মিত করল। সবাইকে ফ্রান্সের তৈরি চিনামাটির বাসনে খেতে দেয়া হয়েছে, আর স্যার খাচ্ছেন মাটির সানকিতে। উনি না-কি মাটির সানকি ছাড়া খেতে পারেন না।
স্যারের দাওয়াতে আমি নিয়মিত হয়ে গেলাম, কিছুদিন পরপরই আমার ডাক পড়ে। আমি সামাজিক মানুষ না। অচেনা সব লোকজনের ভিড়ে অস্বস্তি বোধ করি। আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে কেউ এগিয়েও আসে না। নিজেকে মনে হয় গৃহকর্তার দরিদ্র আত্মীয়, যাকে আসর থেকে বাদ দেয়া যায় না, আবার আসরে রাখাও যায় না।
উপগ্রহ আমার খুব অপছন্দের জিনিস। স্যারের কাছে আমার অবস্থান ছিল উপগ্রহের মতো।
তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। খবর পেয়ে আমি দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক জনাব সালেহ চৌধুরীকে নিয়ে তাঁকে দেখতে গেলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি বই পড়ছেন। বইটির নাম অমানুষ। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
সালেহ চৌধুরী বললেন, স্যার, কেমন আছেন?
তিনি বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, পরে আসুন। এখন ব্যস্ত আছি। বই পড়ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের ঘটনায় খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। সেদিনের ঘটনায় সব দুঃখ ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল।
১৯৭১ নামের উপন্যাসটি আমি উৎসর্গ করেছিলাম স্যারের নামে। বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে তাঁর হাতে দিলাম। তিনি পাতা উল্টে বললেন—যে বইয়ের নাম ১৯৭১, তার পৃষ্ঠাসংখ্যা মাত্র সর?
আমি জবাব দিলাম না। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর তিনি আমাকে তার বাসায় ডেকে পাঠালেন। সরাসরি ঢুকে গেলাম তার পড়ার টেবিলের ওপর ঝুলানো মশারির ভেতর। স্যার বললেন, নিজের হাতে খাঁটি ঘি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছি। খাবেন?
আমি বললাম, জি-না স্যার।
আপনাকে ছোট্ট একটা উপদেশ দেবার জন্যে ডেকেছি। আপনাকে লেখালেখি নিয়ে অনেকেই অনেক উপদেশ দিতে চেষ্টা করবে। আপনি কোনো উপদেশই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন না। আপনার যা মনে আসে লিখবেন। ঠিক আছে?
আমি বললাম, জি স্যার।
রাজ্জাক স্যারের মতো একই উপদেশ একটু ভিন্ন ভাষায় আরেকজন আমাকে দিয়েছিলেন। তার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই গল্প আরেকদিন বলা যাবে।
পাদটিকা:শামসুর রাহমান এবং হুমায়ুন আহমেদের নাম কেন বাদ দেয়া হয়েছিল তা কখনো জানা হয় নি।
একটু পেছনে ফিরি
একটু পেছনে ফিরি।
১৯৬৫ সন। আমি পড়ি ঢাকা কলেজে। এখনকার ছেলেপুলেরা বলে ‘ইন্টার’। সেই ইন্টারের ছাত্র। থাকি হোস্টেলে। প্রচুর স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা ভোগ করার উপায় নেই। কারণ আমার মামাও হোস্টেলে একই রুমে আমার সঙ্গে থাকেন। তিনি সিরিয়াস ধরনের ছাত্র। কোনো ক্লাস মিস করেন না। সন্ধ্যার পর পরই বই নিয়ে বসেন।