মিছিলের স্লোগান ‘হুমায়ূন আহমেদের চামড়া তুলে নেব আমরা’। আমি মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ শুনি আমার তিন মেয়ে এবং তাদের এক বান্ধবী (ফ্ল্যাটের হাউস টিউটর সাহেবের মেয়ে পাল্টা স্লোগান দিচ্ছে—
হুমায়ূন আহমেদের চামড়া
লাগিয়ে দেব আমরা।
আনন্দে সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল।
এবার দুঃখস্মৃতির কথা বলি। রাত আটটা। হঠাৎ গেটের সব বাতি নিভে গেল। আমি ভয়াবহ আর্তচিৎকার শুনলাম, স্যার, আমাকে মেরে ফেলছে। আমাকে বাঁচান।
আমি বারান্দায় এসে দেখি তিনজন মিলে একটা ছেলেকে গেটের সামনে চেপে ধরেছে। অন্য একজন তার শরীরে ছুরি বসাচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।
আমার খালি গা। পরনে লুঙ্গি। এই অবস্থায় দৌড়ে নিচে নামলাম। দ্বিতীয় কেউ এগিয়ে এল না। অথচ হলভর্তি ছাত্র। অনেক দারোয়ান। অনেক হাউস টিউটর।
যারা ছুরি মারছিল তারা আমাকে দেখে থমকে গেল। আমার একবারও মনে হলো না এরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। আমি পাগলের মতো এদের ধরার জন্যে ছুটছি। তারা পুকুরের দিকে যাচ্ছে। আমি ছুটছি তাদের পেছনে। এমন সময় আমার পাশের হাউস টিউটর চেঁচিয়ে বললেন, হুমায়ূন সাহেব, কী করছেন? ফিরে আসেন।
আমার সংবিত ফিরল। আমি আহত ছেলেটির কাছে এলাম। গেটের অন্য পাশের হাউস টিউটর সাহেবকে নিয়ে ছেলেটিকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
রক্তে আমার সারা শরীর ভিজে গেল। এই প্রথম রক্তস্নান করলাম।
যাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, সে নিজেও ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী। তার দল খবর পেয়ে হাসপাতাল থেকে তাকে নিয়ে গেল। সে বেঁচে ছিল না মারা গিয়েছিল কিছুই জানি না।
শহীদুল্লাহ হলে আমি অনেক লেখা লিখেছি। কয়েকটার নাম দিলাম আমার আছে জল। জনম জনম। সাজঘর। পুতুল। চারটা নাম দিলাম, কারণ এই চারটাই বিভিন্ন পরিচালক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
১৫.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় মানুষ ছিলেন। বিয়ে করেন নি, চিরকুমার মানুষ। সবসময় পায়জামা এবং গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরতেন। খুব কম কথা বলতেন, তবে অতি ঘনিষ্ঠদের কাছে মজলিশি মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার চেহারার সঙ্গে হো চি মিনের চেহারার সাদৃশ্য ছিল। তিনি নিয়ম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যেতেন। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা খেলতেন। অস্থিরতা নামক বিষয়টি তার মধ্যে কখনো দেখি নি, তবে দাবা খেলার শেষের দিকে (যখন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে) কিছু অস্থিরতা দেখা যেত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাধর মানুষদের উনি ছিলেন একজন। তার ক্ষমতার উৎস আমি জানতাম না। শুনেছি তিনি হ্যারল্ড লাস্কি নামক জগৎবিখ্যাত অধ্যাপকের সঙ্গে Ph.D করছিলেন। থিসিস লেখার শেষ পর্যায়ে হ্যারল্ড লাস্কি মারা যান। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক থিসিস জমা না দিয়েই দেশে ফিরে আসেন। কারণ তাঁর ধারণী হয়েছিল, যারল্ড লাস্কি ছাড়া এই থিসিসের মর্ম কেউ বুঝবে না।
আমি হ্যারল্ড লাস্কিকে চিনি না। কেন তিনি জগৎবিখ্যাত তাও জানি না। আমি তার ছাত্রের প্রতি সবার সমীহ দেখে অবাক হই। এমন না যে অধ্যাপক রাজ্জাক অনেক বইপত্র লিখে নিজেকে বিকশিত করেছেন। আমার মনে হয় তিনি তাঁর প্রতিভার পুরোটাই দাবা খেলায় ব্যয় করেছেন। সেখানেও তেমন কিছু করতে পারেন নি। বেশির ভাগ সময়ই অন্যদের কাছে হেরেছেন। আমি অতি নিম্নমানের দাবা খেলোয়াড়। তিনি আমার কাছেও মাঝে মধ্যে হারতেন। চাল ফেরত নেয়া দাবা খেলায় নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কাজটি সবসময়ই করতেন।
অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে মাতামাতি শুধু যে দেশেই তা-না, বিদেশেও। দেশের বাইরের অনেকেই তার পরামর্শে তার অধীনে Ph.D করেছেন। অনেক গবেষণাপত্র উৎসর্গ করা হয়েছে তার নামে। এক বাঙালি অর্থনীতিবিদ ঢাকায় এলেই রাজ্জাক স্যারের বাসায় যেতেন। তিনি কয়েকবার তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবেও নিয়ে এসেছেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন—“এই ছেলে Economics ভালো জানে।”
Economics জানা মানুষটির নাম অমর্ত্য সেন। যিনি পরে ইকনমিক্সে নোবল পুরস্কার পান।
প্রস্তাবনাপর্ব শেষ, এখন মূল গল্পে আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তখন পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি আমাকে অফিসে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, একটা কাজ করে দিতে হবে। আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের একটি ইংরেজি বক্তৃতা বাংলায় অনুবাদ করে দিতে হবে। উনি বিশেষ করে আপনার কথা বলেছেন।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আমার নাম জানেন, এতেই আমি যথেষ্ট আত্মশ্লাঘা অনুভব করলাম। কারণ তখনো তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি। তাঁর সঙ্গে দাবা খেলারও শুরু হয় নি।
আমি বললাম, স্যার, আমি অবশ্যই অনুবাদ করে দেব।
ভাইস চ্যান্সেলর স্যার বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মূল বক্তৃতাটা রাজ্জাক সাহেবের। আশা করি গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। হুবহু অনুবাদ করবেন। একচুলও যেন এদিক-ওদিক না হয়।
স্যার, আপনি নিশ্চিত থাকুন। হুবহু অনুবাদ করব।
শহীদুল্লাহ হলে রাজ্জাক সাহেবের পাণ্ডুলিপি নিয়ে ফিরেই অনুবাদে হাত দিয়েছি। একটা জায়গায় এসে থমকে গেলাম। এইসব কী লিখেছেন?