আমার ভাগ্য খানিকটা বদলালো, শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেলাম। হাউস টিউটর মানে ফ্রি বাসা। ফ্রি ইলেকট্রিসিটি, ফ্রি গ্যাস ও পানি। আমি মহানন্দে শহীদুল্লাহ হলের গেটে সংসার পাতলাম। হলের গেটের দু’পাশে দুই হাউস টিউটরের বাসা। তারা এক অর্থে হলের গেটকিপার। হলের ভেতরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তারাই প্রথম জানবেন।
ঢাকা শহরের সুন্দর কিছু জায়গার একটি শহীদুল্লাহ হল। হলের সামনে প্রাচীন কিছু বৃক্ষ। সেখানে বাস করে রাজ্যের টিয়া পাখি। একসঙ্গে এত টিয়াপাখির বাস বাংলাদেশে আর কোথাও আছে বলে আমি জানি না। সন্ধ্যাবেলা সব পাখি একসঙ্গে ডাকাডাকি করে চারপাশ রহস্যময় করে তোলে।
হলের পাশের বিশাল দিঘিটাও রহস্যময়। প্রতিবছরই সেই দিঘিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে কেউ-না-কেউ মারা যায়। দিঘির পাড়ে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ সাইনবোর্ডও লাগানো আছে। দিঘির পানি কাঁচের চেয়েও পরিষ্কার।
রহস্যময় এই দিঘিতে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ জেনেও আমি আমার তিন মেয়েকে এই দিঘিতেই সাঁতার কাটা শিখিয়েছি। অনেক পূর্ণিমার রাতে দিঘির জলে সপরিবারে নেমেছি। একই সঙ্গে জলস্নান এবং চন্দ্রম্নান।
আমার তিন মেয়ে শহীদুল্লাহ হলের দিঘিতে শুধু যে সাঁতার শিখেছে তা না, তারা হলের সামনের মাঠে সাইকেল চালাতেও শিখেছে। ট্রেইনার আমি। বড় মেয়ে নোভা প্রথম যেদিন সাইকেল চালানো শিখল, সেই দিনের দৃশ্য আমার এখনো চোখে ভাসে। সে প্যাডেল করছে। আমি সাইকেলের পেছনটা ধরে আছি। সে একটু পরপর বলছে—ড্যাডি, আমাকে ছেড়ে দিও না। ছেড়ে দিলেই আমি পড়ে যাব। আমি বললাম, মা, আমি শক্ত করে ধরে আছি। ছাড়ব না। তুমি এক চক্কর ঘুরে আস।… আমি ততক্ষণে সাইকেল ছেড়ে দিয়েছি। নোভা যে একা একা যাচ্ছে তা সে জানে না। পুরো চক্কর দিয়ে এসে হঠাৎ সে আমাকে দেখল—আমি সিগারেট টানছি। নোভা বিকট চিৎকার দিল, বাবা, আমি সাইকেল চালানো শিখে গেছি। বলেই সে সাইকেল নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল।
আমার মেয়েদের যদি কখনো জিজ্ঞেস করা হয়–বাবার বিষয়ে তোমাদের সবচেয়ে সুখের স্মৃতি কী? তারা অবশ্যই সাঁতার শেখা এবং সাইকেল চালানো শেখার কথা বলবে।
আমি মেয়েদের পেছনে কোনো সময়ই দিতে পারি নি। ইউনিভার্সিটির চাপ, হলের চাপ, লেখালেখিতেই সময় চলে যেত। তখন আমার দু’জন থিসিসের ছাত্র ছিল। তাদের রিসার্চের কাজ দেখাশোনাতেও প্রচুর সময় যেত। ইউনিভার্সিটির ছুটির দিনে সন্ধ্যার পর কিছু অবসর পেতাম। তখন চলে যেতাম ইউনিভার্সিটি ক্লাবে দাবা খেলতে। দাবা খেলতাম রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে (হ্যারল্ড লাস্কির প্রিয় ছাত্র অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। কিংবদন্তি শিক্ষক)। দাবা খেলার সময়টা আমি আমার পরিবারকে দিতে পারতাম। তাও দেই নি। কারো বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, জন্মদিন, বিয়ে—এইসবে আমি নেই। সম্পূর্ণই নিজের ভেতরে বাস করা।
সবকিছু দেখেশুনেই হয়তো আমার মেয়েরা আবদারশূন্য মানসিকতায় বড় হতে লাগল। তারা কেউ কখনো আমার কাছে কিছু চেয়েছে বলে আমি মনে করতে পারি না। মেয়েদের কাছে আমি ছিলাম ভিনগ্রহের মানুষ। তারা আমার। চোখের সামনে বড় হচ্ছে, এই পর্যন্তই। তাদের জন্যে আদর নেই, বকাও নেই। তারপরেও কী কারণে যেন বড় মেয়ে নোভার ওপর রাগ করে তার গালে একটা চড় দিয়ে বসলাম। মেয়ে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাসও করাতে পারছে না আমি এমন একটা কাজ করতে পারি।
আমি বললাম, মা, আমি খুবই ভুল একটা কাজ করেছি। বুঝতে পারছি তুমি মনে কষ্ট পেয়েছ! বলো কী করলে তোমার মনের কষ্ট দূর হবে। আমি তাই করব।
নোভা বলল, বাথরুমে একটা বাথটাব বসিয়ে দাও। বাথটাবে গোসল করলে মনের কষ্ট কমবে।
আমি বাথটাবের ব্যবস্থা করলাম।
কয়েকদিন আগে কবি নির্মলেন্দু গুণের মেয়ে মৃত্তিকার সঙ্গে দেখা। সে বলল, আঙ্কেল, আপনার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় আমি কী করতাম আপনার মনে আছে?
কী করতে?
বাবার সঙ্গে প্রায়ই বেড়াতে যেতাম। যে কাপড় পরে যেতাম সেই কাপড়েই লাফ দিয়ে আপনাদের বাথটাবে নেমে পড়তাম।
.
শহীদুল্লাহ হলে থাকার সময়ই অনিন্দ্য প্রকাশনীর মালিক আমাকে আমার বইয়ের রয়েলটির টাকা না দিয়ে সেই টাকায় একটা গাড়ি কিনে দিলেন। গাড়ির সঙ্গে একজন ড্রাইভার দিয়ে দিলেন।
নতুন গাড়ি দেখে আমার মেয়েদের সে-কী লাফালাফি! সে-কী চিৎকার! মেজো মেয়ে শীলা তার বান্ধবীকে টেলিফোন করে বলল, বাবা না আমাদের জন্যে একটা গাড়ি কিনেছে। গাড়ির সঙ্গে একজন ড্রাইভার কিনে এনেছে।
একটা গাড়িই আমার জন্যে যথেষ্ট। আমি রয়েলটির টাকা পেয়ে আরেকটা মাইক্রোবাস কিনে ফেললাম। ব্যাংকে কোনো জমা টাকা নেই, অথচ শহীদুল্লাহ হলের বাসার সামনে দু’টা গাড়ি। মেয়েরা বান্ধবীদের নিয়ে মাইক্রোবাসে বসে রান্নাবাটি খেলা খেলে।
দ্বিতীয় গাড়ি কেনার মানসিকতাটা ব্যাখ্যা করি। রয়েলটির টাকা হাতে নিতে বা জমা করে রাখতে আমার লজ্জা লাগত। আমার মনে হতো এটা ঠিক না। কেন বই লিখে এত টাকা পাব! এই কারণেই যা পেতাম সঙ্গে সঙ্গে খরচ করে ফেলতাম।
শহীদুল্লাহ হল নিয়ে আমার অসংখ্য সুখস্মৃতি আছে। একটা সুখস্মৃতি বলি।
আমি একটা বিষয়ে (টাকা চুরি) কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে হলের একটি ছাত্রকে হল থেকে বের করে দেবার সুপারিশ করেছি। সে একটি ছাত্র সংগঠনের কর্তাব্যক্তি। সংগঠন তার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল এবং মিছিল বের করল।