মিলনের উত্তর শুনে আনন্দ পেলাম। সে বলল, হুমায়ূন ভাই, এঁরা বাংলাদেশে এসে সবাইকে তুমি তুমি করেন। কাজেই আমিও করি। সম্বোধনে সমান সমান।
আমার সমস্যা হচ্ছে আমি কাউকেই তুমি করে বলতে পারি না। তুমি তুমি বলার বন্ধু আমার নেই। সবার সঙ্গেই ফর্মাল সম্পর্ক। একদিন শাওন বলল, তোমার যে কোনো বন্ধু নেই এটা কি তুমি জানো? তোমার পরিচিতজন আছে, বন্ধু নেই। তুমি অতি নিঃসঙ্গ মানুষদের একজন।
আমি চিন্তা করে দেখলাম ঘটনা তো সেরকমই। বন্ধু নেই একজন মানুষ বাঁচে কীভাবে? আমি তো ভালো আছি এবং সুখেই আছি। কিছুক্ষণ চিন্তা করেই রহস্যের সমাধান বের করলাম (আমি আবার মিসির আলি তো)। আমার মাথায় সবসময় গল্প কিংবা উপন্যাস থাকে। গল্প-উপন্যাস যখন যেটা লিখছি তার চরিত্রই বন্ধু হিসেবে থাকে। বাইরের বন্ধুর প্রয়োজন সে কারণেই হয় না।
ইমদাদুল হক মিলনের কাছে ফিরে যাই। তার সঙ্গে প্রথম দেখা বইমেলায়। আমেরিকা থেকে ফেরার পর প্রথম বইমেলায় গিয়েছি। একটা স্টলের সামনে ভিড়। লেখকের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেয়া হচ্ছে। লেখক দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তার পরনে জিন্সের প্যান্ট। মাথা সম্ভবত কামানো। লেখকের চেহারা মোটেই লেখকসুলভ নয়। দেখাচ্ছে পাড়ার মাস্তানদের মতো। আমি এই লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচিত নই। নামের সঙ্গেও না। আমি তার একটা বই কিনলাম (ও রাধা ও কৃষ্ণ) এবং লাইনে দাঁড়ালাম অটোগ্রাফের জন্যে। আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে একবারই কারো কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছি।
মিলন খুব সম্ভব নিজেকে প্রেমের উপন্যাসের লেখক হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছিল। কম বয়সের জনপ্রিয়তার এই একটা সমস্যা। লেখক পাঠকদের চাহিদার কাছে নতজানু হন। মিলনের লেখার ক্ষমতার বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হবার ব্যবস্থা সে করে রেখেছে, তারপরেও তার ক্ষমতার ভুল ব্যবহার দেখে অনেকবার ব্যথিত হয়েছি।
ওয়ার্ড কমিশনাররা ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেন। আমি ওয়ার্ড কমিশনারের মতো মিলনকে একটা সার্টিফিকেট দিচ্ছি—
যার জন্যে প্রযোজ্য
লেখক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। সে অতি, অতি বিনয়ী। ঘরোয়া আড্ডায় কখনো তাকে উত্তেজিত হতে দেখে নি। বাংলা সাহিত্যের পড়াশোনা তার ব্যাপক। বাংলা ভাষায় এমন কোনো বই লেখা হয় নি যা সে পড়ে নি। তার চরিত্রে জল-স্বভাব প্রবল। যে-কোনো পাত্রেই তাকে রাখা যায়। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে সে জড়িত না। আমি তার সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করি।
সার্টিফিকেট প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন আমি নিজে একটা সার্টিফিকেট যে পেয়েছিলাম সেই গল্পটা বলি। একদিন এক যুবক ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে বলল, তার হাতের লেখা অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতো। সে কিছু নমুনাও নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, দেশ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ তোমাকে পেলে লুফে নিতেন। একের পর এক রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশ করতেন।
আমি তাকে দিয়ে নিজের জন্যে রবীন্দ্রনাথের একটা সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিলাম। সেখানে লেখা
শ্রীমান হুমায়ূন আহমেদ,
তোমার কিছু রচনা পাঠ করিয়া বিমলানন্দ পাইয়াছি। তোমার কিছু শব্দের বানান বিষয়ে আমার কথা আছে। সাক্ষাতে বলিব।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৪.
নামের আগে ড. লাগিয়ে বসে আছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। কিন্তু সংসার চালিয়ে নিতে পারছি না। পত্রিকায় পড়ার মতো কোনো খবর নেই এই অজুহাত দেখিয়ে বাসায় পত্রিকা রাখাও বন্ধ। আমেরিকায় গুলতেকিন নানান কাজকর্ম করে কিছু রোজগার করত। বাংলাদেশে সেই রোজগারও বন্ধ। সে কোথাও যে চাকরি নেবে তাও সম্ভব না। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। S.S.C পাশের পর বিয়ে হয়েছে। আমেরিকায় তাকে পড়াশোনা করানো সম্ভব হয় নি। [তবে সে দেশে ফিরে পড়াশোনা শুরু করেছিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম, এ ডিগ্রি নিয়েছিল।]
আগের কথায় ফিরে যাই। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কী করা যায় বুঝতে পারছি না। একদিন শুনলাম সেবা প্রকাশনীর আনোয়ার হোসেন সাহেবকে বই অনুবাদ করে দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ নগদ টাকা দেন। গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমার হাতে একটা ইংরেজি বই ধরিয়ে দিয়ে বললেন, অনুবাদ করে নিয়ে আসুন। পড়ে দেখি কেমন হয়েছে। ভালো হলে ছাপব। নগদ টাকা দেব। বইটার নাম Man on fire.
সাতদিনের মাথায় অনুবাদ শেষ করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলাম। বইটার নাম দিলাম অমানুষ। আমার ধারণা ছিল অনুবাদ পড়লে এই বই তিনি ছাপবেন না। কারণ আমি মূল উপন্যাসের কাঠামো ঠিক রেখে সম্পূর্ণই আমার মতো করে লিখেছি। বাঙালি এক যুবকের গল্প, যার নাম জামশেদ। আনোয়ার হোসেন সাহেব পাণ্ডুলিপি না পড়েই সেদিন আমাকে তিনশ’ টাকা দিলেন। সেবা প্রকাশনীর জন্যে আমি আরো দুটা বই অনুবাদ করেছি। একটির নাম সম্রাট, আরেকটির নাম দ্যা এক্সেসরিস্ট। ভূতের গল্প। শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্যে লেখালেখি করাকে অনেকেই ছোট চোখে দেখেন। আমি অর্থ উপার্জনের জন্যে বই অনুবাদ করেছি। এই সত্য প্রকাশে কোনোরকম লজ্জা বোধ করছি না।