তিনি বললেন, হ্যাঁ নিয়েছি।
আমি বললাম, আমিও ঠিক তাই করেছি। নাটক লেখার জন্যে টাকা নিয়েছি। আপনি হৈচৈ করছেন কেন? একজন লেখক চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচেন না। তাকে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট খেতে হয়।
আপনি কেন বললেন, রঙিন টিভি কেনার জন্যে নাটক লিখেছেন?
যেটা সত্যি আমি তাই বলেছি। আপনাকে ডেকেছি রঙিন টিভিটা দেখার জন্য। নিজের চোখে দেখুন আমার বাচ্চারা কত আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখছে। বেতনের টাকা দিয়ে বাচ্চাদের এই টিভিটা কিনে দেবার সামর্থ্য আমার ছিল না।
আবুল খায়ের সাহেব খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ আমার বাচ্চাদের সঙ্গে টিভি দেখলেন। একসময় তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ভুল করেছি। ক্ষমা চাই।
খায়ের ভাইয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। নতুন কোনো নাটক বানাতে গেলেই আমার তার কথা মনে পড়ে। খায়ের ভাইয়ের সমকক্ষ অভিনেতা বাংলাদেশে আছে বলে আমি মনে করি না।
১৩.
বলপয়েন্টে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। এই ঘটনার পর এই ঘটনা ঘটল লিখে লেখকজীবনের ইতিহাস লেখায় আমি যাচ্ছি না। যখন যা মনে আসছে তাই লিখছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার নেই। চিঠিপত্র বা
ফটোগ্রাফ জমানোর মধ্যেও নেই। আমার সমস্ত সঞ্চয়ই স্মৃতিতে।
আমার মৃত্যুর পর পত্রিকাওয়ালারা একটা সমস্যায় পড়বেন। ‘হুমায়ূন আহমেদের ডায়েরি’ বা ‘অপ্রকাশিত জার্নাল’ নামে কিছু ছাপাতে পারবেন না।
সাহিত্যের লাইনের গ্রান্ডমাস্টারদের কেউ কেউ আমাকে চিঠি লিখেছেন। সেইসব চিঠিও জমা করে রাখি নি। আমার মানসিকতায় নিঃসঙ্গতা ব্যাধি আছে। নিঃসঙ্গতা ব্যধিগ্রস্তরা তাদের পাশে কিছুই জমা করতে ভালোবাসে না। প্রাণপণ চেষ্টা করে সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে। উদাহরণ দেই।
ঔপন্যাসিক বিমল মিত্র এসেছেন বাংলাদেশে। উঠেছেন সোনারগাঁও হোটেলে। কৈশোরে বিমল মিত্রের বিশাল বই কড়ি দিয়ে কিনলাম খাটের তলায় বসে পড়ে শেষ করেছি। ক্ষণে ক্ষণে অশ্রুবর্ষণ করেছি। সবার সামনে এই বই পড়ার উপায় ছিল না, কারণ Out book হিসেবে একজন কিশোরের কাছে সেই। বই নিষিদ্ধ।
কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম-এর বিমল মিত্র ঢাকায় শুনেই ভালো লাগল। এক সন্ধ্যায় বিমল মিত্রের কাছ থেকে টেলিফোন, হুমায়ূন, আসো আমার সঙ্গে দেখা করে যাও।
আমার আনন্দিত হয়ে ছুটে যাওয়া দরকার ছিল। তা না করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি কারোর সঙ্গে দেখা করি না। আমি আসছি না। আপনি কিছু মনে করবেন না।
যত বিনয়ের সঙ্গেই কথাগুলি বলা হোক, বিমল মিত্রের কাছে তা সুখকর নিশ্চয়ই ছিল না। আমার কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা—-লেখককে চিনব তার লেখা দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চেনার কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব লেখকের প্রতি আমার একধরনের বিরাগও ছিল। তারা পিঠ চাপড়ানো কথা বলতে ভালোবাসেন। নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবেন। বাংলাদেশের লেখকদের জল-চল জাতের উপরে কিছু ভাবেন না।
এখনো যে সেই অবস্থার ইতরবিশেষ হয়েছে তা-না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম ঢাকায় আসার ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। চারদিকে ফিসফাস ভাব। সুনীল এসেছেন। পাঠকদের হাত থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। খবর পেলেই পাঠকরা প্রিয় লেখকের ওপর হামলে পড়বেন। তিনি কোথায় আছেন তা সম্পূর্ণ গোপন। যাদের সঙ্গে আছেন তারা মহাভাগ্যবান। হিসেবে চিহ্নিত। তারা কিছু Exclusive পার্টির ব্যবস্থা করছেন। অতি ভাগ্যবানরা সেই পার্টিতে যাবার সুযোগ পাচ্ছেন।
আমি তেমন এক পার্টিতে যাবার সুযোগ পেলাম। জনৈক প্রকাশকের বাড়িতে পার্টি। আমাকে কয়েকবার টেলিফোনে জানানো হলো যেন একা যাই। কাউকে সঙ্গে না নিয়ে যাই। এবং ঘটনাটা প্রচার না করি। প্রচার হয়ে গেলে জনতা সামলানো কঠিন হবে। ইত্যাদি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রথম দেখলাম। হাতে সিগারেট এবং হুইস্কির গ্লাস। আশেপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হলো না। তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সুনীলের পাশে বসেন নি। তার হাতে কোনো গ্লাস নেই। তাঁকে খানিকটা বিব্রত মনে হচ্ছে। ঘরে আলো কম। অন্য ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। কঠিন পরিবেশ যাকে বলে।
পার্টিতে নিমন্ত্রণপ্রাপ্তরা বেশিরভাগই লেখক। তারা তাদের সব বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। বই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। তিনি পাতা উল্টে পাশে রেখে দিচ্ছেন। সাহিত্য এবং কাব্য আলোচনা চলছে। এমন কৃত্রিম কথাবার্তা এবং আচরণ আমি আমার জীবনে কম দেখেছি। শুরু হলো ফটোসেশন। একেকজন লেখক যাচ্ছেন, নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে ফিরছেন। মন ভরছে না। তিনি আবারো যাচ্ছেন।
গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণায়মান উপগ্রহদের ভেদ করে আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছতে পারলাম না। তাকে দেবার জন্যে আমি আমার একটা উপন্যাস নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা তাঁকে দেয়া হলো না। গোপনে ফেরত নিয়ে চলে এলাম।
আসরে ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের ব্যবহার একটু অদ্ভুত মনে হলো। সে দেখি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সমানে তুমি তুমি করে সম্বোধন করছে। সমরেশ মজুমদার একবার এলেন। মিলন তাঁকেও দেখি তুমি করে বলছে। একদিন মিলনকে বললাম, এঁরা বয়সে তোমার চেয়ে অনেক বড়। তুমি অবলীলায় তাদের তুমি বলছ কীভাবে?